Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

যাঁদের নিয়ে বড়াই, তাঁরাই মোদীর দায়

দলের যাঁরা সম্পদ ছিলেন এত দিন, বিজেপিতে তাঁরাই এখন দায় হয়ে উঠছেন একে একে! বিজেপি নেতারাই মানছেন, বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াই হোন বা রমন সিংহ, কিংবা শিবরাজ সিংহ চৌহান বা মহারাষ্ট্রের নবাগত মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস— এঁদের রাজ্যে ঘটে চলা একের পর এক কাণ্ডের জন্যই এখন প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৫ ০৪:০৪
Share: Save:

দলের যাঁরা সম্পদ ছিলেন এত দিন, বিজেপিতে তাঁরাই এখন দায় হয়ে উঠছেন একে একে!

বিজেপি নেতারাই মানছেন, বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াই হোন বা রমন সিংহ, কিংবা শিবরাজ সিংহ চৌহান বা মহারাষ্ট্রের নবাগত মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস— এঁদের রাজ্যে ঘটে চলা একের পর এক কাণ্ডের জন্যই এখন প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। অথচ মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির শিক্ষাগত যোগতা নিয়ে কিছু চাপানউতোর ও বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে ঘিরে বিতর্ক— এই দু’টি প্রসঙ্গ বাদে প্রথম বছর পেরিয়ে আসা মোদী সরকারের আর কোনও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বড় কোনও দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেননি বিরোধীরা। মোদী সরকারের বড় মাথাব্যথা এখন দলের মুখ্যমন্ত্রীরাই।

এটা ঘটনা, দক্ষিণের প্রথম বিজেপি-শাসিত রাজ্য কর্নাটকে বি এস ইয়েদুরাপ্পায় হাত পোড়াতে হয়েছিল দলকে। দুর্নীতির দায়েই মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরতে হয়েছিল ইয়েদুরাপ্পাকে। দিল্লিতে তখন কংগ্রেসের সরকার। ফলে ভাবমূর্তিতে আঁচ পড়লেও বড় সঙ্কটে পড়তে হয়নি দলকে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। কেন্দ্রে নিজেদের সরকার। ফলে রাজ্যে-রাজ্যে অনিয়ম, দুর্নীতির আঁচ সরাসরি আছড়ে পড়ছে রাজধানী দিল্লিতে। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলছে বিরোধীরা। সংসদে যাবতীয় সংস্কারমুখী বিল পেশ ও পাশ করানো অসম্ভব হয়ে ওঠার জোগাড়।

অথচ বিজেপি তার মুখ্যমন্ত্রীদের দলের সম্পদ বলেই গণ্য করে এসেছে বরাবর। তাঁদের মধ্যেই একটি মুখকে সামনে রেখে গত লোকসভা ভোটে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়েছিল দল। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী মোদীও তাঁর প্রচারে দেশকে সুশাসনের আশ্বাস দিতে গিয়ে নিজ-রাজ্যের পাশাপাশি অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের প্রশাসনিক সাফল্যের দৃষ্টান্তই তুলে আনতেন। সুশাসন দেওয়ার প্রশ্নে বিজেপি ও কংগ্রেসের ফারাকটা তিনি এ ভাবেই তুলে ধরতেন। বিজেপির অন্য নেতারাও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসকের ‘আইকন’ হিসেবে দেখিয়ে এসেছেন দলের মুখ্যমন্ত্রীদের। ঠিক যেমন মোদীর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া ঠেকাতে শিবরাজ সিংহ চৌহানের নাম ব্যবহার করেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। মোদী ক্ষমতায় আসার পরেও সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে।

সপ্তাহ দুই আগেও বিজেপি শিবিরের কেউ ভাবেননি, রাজস্থানে বিপুল শক্তি নিয়ে জিতে আসা বসুন্ধরাকে নিয়ে এমন বেগ পেতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। অথচ নিত্যদিন এখন প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা। সংসদের আসন্ন অধিবেশনও স্তব্ধ করে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বিরোধীরা রোজই একটি একটি করে অভিযোগ সামনে আনছে। যাতে সংসদ পর্যন্ত এই বিতর্কের রেশ জিইয়ে রাখা যায়।

শুধু বসুন্ধরা নন, অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগও সেই তালিকায় যোগ করছে বিরোধীরা। মধ্যপ্রদেশে ভায়াপম কেলেঙ্কারিতে যে ভাবে একের পর এক অভিযুক্ত ও সাক্ষীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে, বিরোধীরা এ বারে সেই প্রসঙ্গেও সরব হচ্ছে। ক’দিন আগেই মোদীর হস্তক্ষেপ চেয়ে এসেছেন কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিংহ। তিনি আজ জানান, প্রধানমন্ত্রীর উপরে আস্থা নেই। তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের বিরুদ্ধে রয়েছে ৭৫ লক্ষ ভুয়ো রেশন কার্ডের অভিযোগ। রমন সিংহের পরিচারকও অভিযুক্ত এই কেলেঙ্কারিতে।

মোদী দিল্লির কুর্সিতে বসার পরে দল ও সঙ্ঘ বিস্তর ঝাড়াই-বাছাই করে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়েছে দেবেন্দ্র ফডণবীসকে। সাত মাসেই মোদীর পছন্দের এই মুখ্যমন্ত্রী হিমশিম খাচ্ছেন রাজ্যপাট চালাতে। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য পঙ্কজা মুন্ডের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, দরপত্র ছাড়াই রাজ্যের স্কুলগুলির জন্য ২৪টি সংস্থাকে একই দিনে ২০৬ কোটি টাকার জিনিস কেনার বরাত দিয়েছেন তিনি। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রী বিনোদ তাওড়ের বিরুদ্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ওঠা অভিযোগের রেশ কাটার আগেই নতুন অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধেও। তাওড়ের দফতরও দরপত্র ছাড়াই ১৯১ কোটি টাকা খরচ করে জেলা পরিষদের সমস্ত স্কুলের জন্য ৬২ হাজার ১০৫টি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত লেনদেন অবশ্য হয়নি। তাওড়ের দাবি, অর্থ দফতর প্রশ্ন তোলায় বিষয়টি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বিরোধীরা কিন্তু একে নতুন এক কেলেঙ্কারি বলেই শোরগোল ফেলে দিয়েছে। মুম্বইয়ের আজ এ নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে কংগ্রেস। অস্বস্তি বাড়িয়ে জোট সঙ্গী শিবসেনাও দুই মন্ত্রীর ইস্তফা চেয়েছে। আবার আজই খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিমান আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে। ফডণবীস অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও বিরোধীরা কিন্তু থামছেন না।

বিজেপির এক নেতা আজ বলেন, ‘‘বিরোধীরা হাজার চেষ্টাতেও এক বছরে সুষমা ছাড়া অন্য কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ তুলতে পারেনি। অভিযোগ আসছে মূলত বিজেপি শাসিত রাজ্য থেকে।’’ ওই নেতার ক্ষোভ, মোদী সরকারের সংস্কারের পদক্ষেপ আটকে দিতেই রাজ্যের বিষয়কে রাজধানীতে নিয়ে আসছে বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও শান্ত হবে না তারা। ওই বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘মোদী পড়েছেন জাঁতাকলে।’’

বিজেপি নেতৃত্ব তাই আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, যাতে রাজ্যের বিতর্ক সেই রাজ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যায়। বসুন্ধরার বিরুদ্ধে দিল্লিতে এআইসিসি দফতরে বসে রোজ যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তার জবাব দিতে দিল্লির কোনও নেতা এগিয়ে আসছেন না। বরং বসুন্ধরাকেই বলা হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে। তাই জয়পুর থেকেই রোজ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সাফাই দিচ্ছেন। মধ্যপ্রদেশে শিবরাজকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, ভায়াপম কেলেঙ্কারির তদন্ত হচ্ছে উচ্চ আদালতের নজরদারিতে। রাজ্যের কোনও ভূমিকা নেই। আর দেবেন্দ্রকেও বলা হয়েছে, তাঁর মন্ত্রীরা সামনে এসে সাফাই দিন। তাতেও কি মোদীর সংস্কারের চাকা ঘুরবে? মসৃণ চলবে সংসদ! ঘোর সংশয়ে বিজেপি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE