নরওয়ের রানি সনিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি। পিছনে রাজা পঞ্চম হেরাল্ডের সঙ্গে প্রণব-কন্যা শর্মিষ্ঠা। অসলোয়। ছবি: পিটিআই
সবটাই কাকতালীয়! নাকি তৈরি হচ্ছে কোনও চিত্রনাট্য!
বিপুল এক হ্রদের অদূরে শহরের মাঝামাঝি যে অভিজাত হোটেলে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় উঠেছেন, তার জানালা দিয়েই তো দেখা যাচ্ছে ‘অসলো সিটি হল’। ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুদিনে গোটা দুনিয়ার নজর থাকবে হাতে গড়া উনিশ শতকের এই অট্টালিকার দিকে। সিটি হলের ‘দ্য গ্রেট হল’-এই শান্তি পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেবেন কৈলাস সত্যার্থী এবং মালালা ইউসুফজাই।
কৈলাস ও মালালাকে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করার কয়েক দিনের মধ্যেই অসলো পৌঁছেছেন রাষ্ট্রপতি। তার পর আজ, এই প্রথম, কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে বরণ করে নেওয়া হল গ্রেট হলে। অসলো শহরের মেয়র তাঁর হাত ধরে ঘুরে ঘুরে দেখালেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাগৃহটি। যার পুবের দেওয়াল জুড়ে নাৎসি আক্রমণের ছবি, আর উত্তরের দেওয়ালে আঁকা নরওয়ের মানুষের দিনযাপনের চিত্র। দেখতে দেখতে মাঝেমধ্যেই থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন রাষ্ট্রপতি। প্রণববাবুর জন্য এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এক ভারতীয় নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানানো হয়। মাদার টেরিজার পরে আরও এক ভারতীয়কে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার জন্য প্রতি-ধন্যবাদ জানান প্রণববাবু।
এক দিকে আবেগ। অন্য দিকে, কৌতুহল! নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক হিসেবে কৈলাস ও মালালার নাম ঘোষণার দিন থেকেই আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে জল্পনা তৈরি হয়েছে, এর নেপথ্যে ভারত-পাকিস্তানকে মেলানোর কোনও পশ্চিমী কূটনীতি কি কাজ করছে? নোবেল প্রাপকদের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ মালালার একটি উক্তি সেই জল্পনা আরও উস্কে দিয়েছে। এক ভারতীয়ের সঙ্গে যৌথভাবে পুরস্কৃত হচ্ছে সে, এই কথা জানার পরে পাক কিশোরী সে দিন বলেছিল, “১০ ডিসেম্বর যখন পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠব, আমি চাই পাকিস্তান ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী অসলোর প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত থাকুন।”
সেই প্রশ্নটাই অসলোতে ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকেও করা হয়। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌশলী ভঙ্গিতে রাষ্ট্রপতি বলেন, “আমি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে রাজনীতির উর্ধ্বে চলে গেছি। এই বিষয়টি রাজনৈতিক স্তরে নির্ধারিত হবে। দুই নেতা কী ঠিক করবেন, সেটা তাঁদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম।”
ছেড়ে দিচ্ছেন নরওয়ের নোবেল কমিটির প্রধান গ্যের লুনডেনস্টাটও। তিনি বলেন, “নোবেল কমিটি নিজে থেকে ভারত বা পাকিস্তানের রাষ্ট্রনেতাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে না। তবে দুই পুরস্কার প্রাপক যদি দুই প্রধানমন্ত্রীকে আসতে বলেন এবং তাঁরা যদি রাজি হন, তা হলে নোবেল কমিটি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীদের আমন্ত্রণপত্র পাঠাবে।” এ বিষয়ে ইসালামাবাদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে, জানান লুনডেনস্টাট। বলেন, “আমি জানতে পেরেছি, প্রধানমন্ত্রী শরিফ ১০ ডিসেম্বর গ্রেট হলে থাকতে আগ্রহী।”
প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে কিছু না বললেও অন্য আর একটি প্রশ্নে ভারত-পাক সমস্যা নিয়ে মুখ খুলেছেন রাষ্ট্রপতি। সীমান্তে বারবার যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কূটনৈতিক মুখ দেখাদেখিও প্রায় বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে প্রণববাবু বলেন, “আমি মনে করি দু’দেশের মধ্যে সব সমস্যা সমাধানের একটাই পথ আলোচনা এবং মুখোমুখি বসে সমঝোতা। কারণ, পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী প্রতিবেশী বাছার সুযোগ এখানে নেই। দু’জনকে পাশাপাশিই থাকতে হবে।”
প্রণববাবুকে আজ শিশু অধিকার ও মহিলাদের ওপর নিপীড়ণ ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। নরওয়ের সাংবাদিকরা জানতে চান, শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে কৈলাস সত্যার্থীর লড়াই নোবেল-স্বীকৃতি পাওয়ার পরে নয়াদিল্লি কি শিশুদের অধিকার রক্ষায় আরও সক্রিয় হবে? সাম্প্রতিক কালে নির্ভয়া কাণ্ড এবং ভারতে একাধিক বিদেশি মহিলার শ্লীলতাহানির ঘটনা নিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়েন রাষ্ট্রপতি। প্রশ্ন ওঠে, ভারতে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে কি আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে না? এর ফলে বিনিয়োগের সম্ভাবনাও ধাক্কা খেতে পারে, মন্তব্য করেন অনেকে।
জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, “শিশুদের অধিকার সুনিশ্চিত করা সব সরকারের কর্তব্য। মালালা ও কৈলাসকে ধন্যবাদ যে, তাঁরা এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।” তবে শ্লীলতাহানি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতির মন্তব্য, “নির্ভয়া কাণ্ড একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা। ভারত মহিলাদের ক্ষমতায়নকে সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পদে ইন্দিরা গাঁধীর নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিভা পাটিলের নির্বাচন, পর পর লোকসভার স্পিকার পদে দুই মহিলা নেত্রীকে বেছে নেওয়া এরই দৃষ্টান্ত।” রাষ্ট্রপতি আরও জানান, মহিলা নিরাপত্তার জন্য সরকার আগের থেকে অনেক সক্রিয় হয়েছে। এতে বিনিয়োগ আক্রান্ত হবে না বলেই তিনি আশাবাদী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy