সান্তা ক্লজের সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।
৬৬ ডিগ্রি ৩৩ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ। সেই কবে ছোটবেলায় তাকে সুমেরু বৃত্ত বলে জেনেছেন! প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে সেই রেখা পার করে আজ সান্তার অতিথি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
সান্তা?
হ্যাঁ! সান্তা ক্লজ। হেলসিঙ্কি থেকে আরও উত্তরে সুমেরুর কাছাকাছি এই শহর রোভানিয়েমি। তারই বুক চিরে চলে গিয়েছে সুমেরু বৃত্ত। সেখান থেকে মাইল খানেক পথ উজিয়ে সান্তা ক্লজের গ্রাম। উত্তর ইউরোপের লোককথা বলে, এখানেই যুগ-যুগান্ত ধরে সান্তার বাস। অন্দরে আলো আঁধারি মাখা তাঁর দফতর। পেল্লাই মাপের পেন্ডুলাম লাগানো একটা ঘড়ি টিক টিক করে চলেছে। পাশেই ডাকঘর, উপহার সামগ্রীর দোকান। তার বাইরে তুষারে ঢাকা স্প্রুসের জঙ্গল। এ দিক ও দিক ঘুরে বেড়াচ্ছে রেইনডিয়ার। ভেসে আসছে ক্রিসমাস ক্যারলের মৃদু ধ্বনি। রোভানিয়েমিতে বারো মাসই যেন বড়দিন!
প্রণববাবুর বয়স হয়েছে। কিন্তু সান্তা যেন আরও থুরথুরে। যেমন ছবিতে দেখেছি। সাদা রঙের গাউন। তার ওপর লাল জ্যাকেট। ধবধবে সাদা কোঁকড়ানো দাড়ি কোমর অবধি ঝুলছে। সান্তার পাশে গিয়ে বসলেন রাষ্ট্রপতি। অন্য পাশে প্রণব-কন্যা শর্মিষ্ঠা। সান্তাকে মার্বেলের তৈরি একটা সাদা হাতি উপহার দেন রাষ্ট্রপতি। প্রণববাবুকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরার আগে সান্তা ভদ্রতার বশে একবার অনুমতিও নিয়ে নিলেন। তার পর বললেন, “ভারতে সকলের জন্য ভালবাসা রইল। বিশেষ করে কচিকাঁচাদের জন্য।”
বিশ্বের সেরা পর্যটন কেন্দ্রগুলির অন্যতম রোভানিয়েমি। বড্ড ঠান্ডা। বারো মাস হিমাঙ্কের নীচেই থাকে পারদ। আজও তাপমাত্রা ছিল শূন্যের সাত ডিগ্রি নীচে। তার সঙ্গে ঝুরো বরফ! ওভারকোট, সোয়েটার ভেদ করে হাড় হিম হাওয়া। তবু উপচে পড়ছে ভিড়। সুমেরুবৃত্তের আকর্ষণ তো রয়েছেই। কপাল ভাল থাকলে রাতের আকাশে সবুজ নীল আলোর খেলাও দেখা যায় মাঝে মাঝে সুমেরুপ্রভা বলে যার খ্যাতি।
সেই আকর্ষণই কি তা হলে টেনে আনল ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকেও? আপাত দৃষ্টিতে তা মনে হলেও সাউথ ব্লকের কূটনীতিকরা বুঝিয়ে দিলেন, এই ‘পা রাখা’ একেবারেই কৌশলগত। আসলে সুমেরুবৃত্তের কূটনীতিতে আগ্রাসী পদক্ষেপ করল নয়াদিল্লি।
সুমেরু অঞ্চলের বরফ যে গলতে শুরু করেছে সে খবর নতুন নয়। উষ্ণায়নের জন্য বরফ গলায় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব কতটা পড়ছে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ২০০৭ সাল থেকে নয়াদিল্লিও সেই গবেষণার শরিক। নরওয়ের অসলো শহরের উত্তরে সুমেরুর কাছে সোয়ালভার্ডে সেই বছরই ‘হিমাদ্রি’ গবেষণা কেন্দ্র শুরু করেছে ভারত। তবে তারও অনেক আগে থেকে এ বিষয়ে সক্রিয় বেজিং। সোয়ালভার্ডেই রয়েছে চিনের সুমেরু গবেষণা কেন্দ্র ইয়েলো রিভার। ভারতীয় গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের আরও তিন বছর আগে সেখানে পা রেখেছে বেজিং। শুধু তাই নয়, সুমেরু অঞ্চলের বিষয় নিয়ে গবেষণার জন্য সাংহাইতে কেন্দ্রও খুলেছে চিন।
সুমেরু অঞ্চলে সঞ্চিত রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের বিপুল ভাণ্ডার। শক্তি ক্ষেত্রে নিজ নিজ চাহিদা মেটাতে যার ওপর নজর এখন গোটা পৃথিবীর। হিসেব মতো, বিশ্বের মোট তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৪০ শতাংশ সঞ্চিত রয়েছে এখানে। সন্দেহ নেই, সেই ভাঁড়ারের অংশীদার হওয়ার দৌড়ে নয়াদিল্লিকে এরই মধ্যে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছে বেজিং। সুইডেন, ডেনমার্কের মতো সুমেরু অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড় কূটনৈতিক যোগাযোগ রেখে চলছে শি চিনফিং প্রশাসন। বিশেষ করে সুমেরু সমুদ্রে তৈল খননের জন্য রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রসনেফ্ট এবং স্কটল্যান্ড ও আইসল্যান্ডের সঙ্গেও চুক্তি সই করেছে চিন।
এ বার নড়েচড়ে বসল নয়াদিল্লিও। সুমেরু বৃত্তের দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত পরিষদে গত বছর চিনের সঙ্গেই পর্যবেক্ষকের মর্যাদা পেয়েছে নয়াদিল্লি। তার পর থেকেই সুমেরু অঞ্চলের কূটনীতিতে ধাপে ধাপে সক্রিয় হচ্ছে ভারত। সুমেরু অঞ্চলের দুই রাষ্ট্র ফিনল্যান্ড ও নরওয়েতে রাষ্ট্রপতির সফরের নেপথ্যে সেটাও বড় কারণ।
কূটনীতিক হিসেব-নিকেষ তো রয়েইছে। সান্তার গ্রামে যেন আজ শুধুই আমোদ-আহ্লাদ। তাই সান্তা ক্লজের পাশ থেকে রাষ্ট্রপতি উঠে দাঁড়াতেই বড়দিন-বুড়োর সঙ্গে ছবি তুলতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল সফরসঙ্গী সাংসদ ও আমলাদের। কে বলবে, সরকার ও সংসদে বড়সড় দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরা। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও শিশু সত্ত্বা যেন তত ক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে সকলের!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy