কেমন আছো সাইগন?
বিমান থেকে মাটিতে পা রেখে স্বগতোক্তির মতোই করে ফেললেন প্রশ্নটা!
ভিয়েতনামের কূটনৈতিক দৌত্য ও কৌশলগত সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে আলোচনার যা কিছু বিষয়, গত দু’দিনে হ্যানয়েই তা সাঙ্গ হয়েছে। কিন্তু এ যাত্রায় সাইগনে আসার আগ্রহটা গোড়া থেকেই যেন চেপে বসেছিল রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চিন্তায়। “সাইগনের সঙ্গে কলকাতার আবেগ ভোলা যায়!”
রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তিনি বামপন্থী নন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ভিয়েতনামবাসীর লড়াই তরুণ এই রাজনীতিককে টলিয়ে দিয়েছিল। সেই স্মৃতি জাগিয়ে তুলে দিল্লি থেকে ভিয়েতনাম আসার পথেই সাংবাদিকদের কাছে প্রণববাবু মন্তব্য করেছিলেন, “সত্যিই ওঁদের জাতীয়তাবাদ আর লড়াই করার মানসিকতা অতুলনীয়!”
এর আগেও এক বার ভিয়েতনাম সফরে এসেছিলেন। প্রণববাবু তখন কেন্দ্রে মনমোহন সরকারের অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সে বার হ্যানয় ছেড়ে বেরোতে পারেননি। কিন্তু বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনায় রাষ্ট্রপতি এ বার স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, হো চি মিন সিটিতে এক বার যেতে চান তিনি। অন্তত সফরের শেষ দিনটা যদি....। সে কথা আর কে ফেলবে!
শহরের তান সন হাঁট বিমানবন্দরটি ঐতিহাসিক! এটি একদা মার্কিন বিমান ঘাঁটি ছিল। এখান থেকেই ‘বি ফিফটি টু’ বোমারু বিমান হামলা করেছিল গোটা ভিয়েতনামে। লাখো মানুষের প্রাণ গিয়েছিল তাতে। কিন্তু টানা দু’দশক ধরে যুদ্ধক্লান্ত এ শহরে রাতারাতি এ কী পরিবর্তন! বিমানবন্দর থেকে শহরের কেন্দ্র পর্যন্ত দু’দিকে যত দূর চোখ যায় একুশ শতকের আধুনিকতার ছোঁয়াচ। বাজার অর্থনীতির প্রভাবের লক্ষণগুলি একে দুই করে চোখ এড়ায় না। মাত্র চার দশকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আচ্ছা আচ্ছা শহরকে ছাপিয়ে গিয়েছে সাইগন। দক্ষিণের এই রাজধানী শহর ইতিমধ্যে উত্তরের হ্যানয়কে ইতিমধ্যে চার গোল দিয়েছে, আর্থিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নে। এখানে এসে প্রণববাবু দেখা করেছেন কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি লিউ তান হাইয়ের সঙ্গে। গিয়েছিলেন ওয়ার মিউজিয়ামেও। তবে মাত্র ১৬ ঘন্টার সাইগন সফরে পরিবর্তনের সব টুকু জানা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু হো চি মিন শহরে ভারতীয় কনস্যুলেটের কূটনীতিকরাই জানাচ্ছেন, গত আর্থিক বছরে ৯ শতাংশেরও বেশি হারে আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে এই শহরের। হ্যানয়ের মাথাপিছু আয় যখন বছরে তিন হাজার ডলারেও পৌঁছয়নি, তখন সাইগনের মাথা পিছু বার্ষিকআয় সাড়ে চার হাজার ডলার ছাপিয়ে গিয়েছে। এ শহরে পশ্চিমীব্র্যান্ডের ‘এক্সক্লুসিভ’ দোকানের ছড়াছড়ি তারই ইঙ্গিতবাহী।
যদিও ইতিহাসবিদরা বলেন, সাইগন বরাবরই সমৃদ্ধ ছিল। মেকং নদীর অবিবাহিকা যেমন উর্বর, তেমনই এই এলাকা সিঙ্গাপুর, তাইল্যান্ডের কাছাকাছি হওয়ায় ঐতিহাসিক ভাবেই বাণিজ্যে গুরুত্ব দিয়েছে। উত্তরে হ্যানয়ের মতো চিনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না।
তবে সাইগনের ডি এফ জে ভিনা ক্যাপিটালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর থ্রং ফুকের মতে, অতীত তিক্ততা ভুলে ২০০০ সালে আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিই সাইগনের অধুনা বৃদ্ধির নেপথ্যে প্রধান অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একগুঁয়ে চিন্তা থেকে সরে এসে বাজার অর্থনীতিকে মেনে নেওয়ার কারণেই বৃদ্ধির পথে হাঁটছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই বাণিজ্য নগরী। ভারতীয় কূটনীতিকদের কথায়, রাষ্ট্রপতির সাইগন সফরের কূটনৈতিক গুরুত্ব একেবারেই নেই বললেও ভুল হবে। আগামী মাসে ভারত সফরে যাবেন ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী। মূলত হো চি মিন সিটি থেকে শিল্প ও বাণিজ্য মহলের একটা বড় প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনি নয়াদিল্লি যাবেন। সেই সফরের দিকে আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে ভারত। ভিয়েতনামের শিল্প সংস্থাগুলির বড় রকমের বিনিয়োগ ভারতে টানতে চাইছে সাউথ ব্লক।
কিন্তু রাষ্ট্রপতি, তিনি কী ভাবছেন? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে ভিয়েতনামের লড়াইয়ে মানসিক ভাবেই দিনরাত্রির সঙ্গী ছিল কলকাতা। কিন্তু উন্নয়নের দৌড়ে সেই কলকাতাকে যোজন পিছনে ফেলে তো এগিয়ে গেল সাইগন!
প্রকাশ্যে অবশ্য প্রণববাবু এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। হয়তো তুলনা টেনেছেন মনে মনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy