Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

জামাতুলের ঘাঁটি ঝাড়খণ্ডে, জানত না পুলিশ

পুলিশ মূলত ব্যস্ত মাওবাদী সন্ত্রাস নিয়ে। আর কিছুটা মাওবাদীদের থেকে ভেঙে বেরিয়ে তৈরি হওয়া সংগঠন পিএলএফআই (পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়য়া) জঙ্গিদের ব্যাপারে। কিন্তু তলে তলে বাংলাদেশের জামাতুল মুজাহিদিন জঙ্গিরা যে রাজ্যের অন্তত দু’টি জেলায় শক্তপোক্ত ঘাঁটি বানিয়ে ফেলেছে, সেটা এত দিন ঝাড়খণ্ড পুলিশের তেমন জানা ছিল না বলে শীর্ষকর্তাদের একাংশই স্বীকার করে নিচ্ছেন।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

পুলিশ মূলত ব্যস্ত মাওবাদী সন্ত্রাস নিয়ে। আর কিছুটা মাওবাদীদের থেকে ভেঙে বেরিয়ে তৈরি হওয়া সংগঠন পিএলএফআই (পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়য়া) জঙ্গিদের ব্যাপারে। কিন্তু তলে তলে বাংলাদেশের জামাতুল মুজাহিদিন জঙ্গিরা যে রাজ্যের অন্তত দু’টি জেলায় শক্তপোক্ত ঘাঁটি বানিয়ে ফেলেছে, সেটা এত দিন ঝাড়খণ্ড পুলিশের তেমন জানা ছিল না বলে শীর্ষকর্তাদের একাংশই স্বীকার করে নিচ্ছেন। আর সেটা বেরিয়ে পড়ল খাগড়াগ়ড় কাণ্ডের পর।

এখনও পর্যন্ত খাগড়াগড় বিস্ফোরণের দুই অভিযুক্ত ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ ও পাকুড় জেলা থেকে ধরা পড়েছে। ১৮ এপ্রিল পাকুড়ের টিলভিট্টা রেল স্টেশনের কাছে গ্রেফতার হয় মুর্শিদাবাদের ইব্রাহিম শেখ। যাকে সোমবার আদালতের নির্দেশে ৮ মে পর্যন্ত হেফাজতে পেয়েছে এনআইএ (জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা)। এ বছরের গোড়ায় বর্ধমানের রেজাউল করিম ধরা পড়ে ঝাড়খণ্ডেরই সাহেবগঞ্জ থেকে।

এমনকী, গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বিস্ফোরণ কাণ্ডের অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত এবং ফেরার, বাংলাদেশের নাগরিক কওসর ওরফে বোমারু মিজানও বীরভূম এবং পাকুড়ের মধ্যে যাতায়াত করছে। পাকুড়ে কওসরের একাধিক গোপন ডেরা আছে বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও অসম যেমন বাংলাদেশের একেবারে লাগোয়া, ঝাড়খণ্ড তা নয়। ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সীমান্ত যোগাযোগ নেই। তার পরেও ঝাড়খণ্ডে জামাতুল মুজাহিদিন জঙ্গিরা ঘাঁটি গাড়ল কেন?

পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ব্যাখ্যা, ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ ও পাকুড় থেকে নদীপথে পশ্চিমবঙ্গের ফরাক্কা কিংবা লালগোলা হয়ে বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জ ও রাজশাহি জেলায় ঢোকা যায়, যে সব জেলা আবার জেএমবি জঙ্গিদের ঘাঁটি বলে পরিচিত। আবার ওই নদীপথ কার্যত অরক্ষিত বলে দুশ্চিন্তা গোয়েন্দাদের। আবার পাকুড় ও সাহেবগঞ্জ থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়াও সোজা। ভৌগোলিক অবস্থান জেএমবি জঙ্গিদের সুবিধে করে দিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের বক্তব্য।

ঝাড়খণ্ডের বঙ্গভাষী অধ্যুষিত সাহেবগঞ্জ, রাজমহল হয়ে গঙ্গা নদী ফারাক্কা ছুঁয়ে পদ্মায় মিশেছে। রাজমহল থেকে নদীপথে পঁচাত্তর থেকে আশি কিলোমিটার পরেই বাংলাদেশে ঢোকা যায়। বাংলাদেশ থেকে কোনওভাবে জলপথে ফারাক্কা এলে সেখান থেকে পাকুড় বা পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ারও পথ রয়েছে। তা সত্ত্বেও ওখানে পুলিশ বা বিএসএফের টহলদারি চোখে পড়ে না বলেই সাধারণ মানুষের অভিযোগ। তাঁরা জানাচ্ছেন, ওই জলপথ ধরেই গরু এবং অন্যান্য পণ্যের চোরাচালান চলছে অবাধে এবং বাংলাদেশ থেকে ঢুকছে অনুপ্রবেশকারীরা, যাদের একাংশ জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িত। বাসিন্দাদের অভিযোগ, সাহেবগঞ্জের রাধানগর ও উধুয়া ও পাকুড়ের বারহারোয়া তল্লাটের কিছু অংশ ইতিমধ্যেই অনুপ্রবেশকারীদের দখলে চলে গিয়েছে।

পরিকাঠামোর অভাবে পুলিশ নদীপথে সব সময় যে টহলদারি চালাতে পারে না তা মেনে নিয়েছেন সাহেবগঞ্জের পুলিশ সুপার সুনীল ভাস্করও। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের টহলদারি চলে অপরাধ আটকাতে। কিন্তু সীমান্ত রক্ষার জন্য বিএসএফ আছে। নদীপথে অনেক ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে যেখানে জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত লোকদের আশ্রয় নেওয়া সহজ।’’ সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যাও প্রচুর বলে পুলিশ জানাচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, এ সব কারণেই জেএমবি-র পক্ষে ঘাঁটি তৈরি সহজ হয়েছে, ইব্রাহিম-রেজাউলরা রীতিমতো সংগঠন তৈরি করেছে। এমনকী, ওই সব তল্লাটে জেহাদি লিফলেট বিলি করার কথাও ইব্রাহিম স্বীকার করেছে বলে ঝাড়খণ্ড পুলিশের দাবি। তা ছাড়া, এনআইএ-র বক্তব্য, পাকুড় ও সাহেবগঞ্জে বাংলাদেশ থেকে জেএমবি জঙ্গিদের যাতায়াত ২০০০ সাল থেকে। খাগড়াগড় কাণ্ডের সূত্রে বেরিয়ে পড়া জঙ্গি-চক্রের বিভিন্ন সদস্যকে জেরা করেই এ কথা জানা গিয়েছে।

পাকুড়ের পুলিশ সুপার অনুপ বিরথারে বলেন,‘‘ ওই সব অঞ্চলের মানুষের ভাষার সঙ্গে পরিচিত ছিল জঙ্গিরা। তাই সেখানে আশ্রয় নিতে সমস্যা হয়নি তাদের।’’

রাজ্য পুলিশের আর এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মতোই সাঁওতাল পরগনায় পুলিশ থেকেছে মাওবাদীদের ঠেকাতে। যার সুযোগ নিয়ে তলায় তলায় বেড়েছে জেহাদি জঙ্গিরা।’’ ওই অফিসারের কথায়, ‘‘ঠিক যেমন রাঁচিতে বসে পটনা বিস্ফোরণের ছক কষেছিল মুজাহিদিন জঙ্গিরা। কারণ, তার জানত রাঁচি কিংবা তার আশপাশের এলাকার পুলিশ বেশি ব্যস্ত থাকে মাওবাদী কিংবা পিএলএফআই জঙ্গিদের নিয়েই।’’

ঝাড়খণ্ড পুলিশের এডিজি (অপারেশনস) সত্যনারায়ণ প্রধান জানান, বিপর্যয় মোকাবিলা বিভাগের থেকে একটি স্পিড বোট নিয়ে নদীপথে টহলদারি শুরু হয়েছে। তবে একটি মাত্র স্পিড বোট দিয়ে যে কাজের কাজ কিছুই হবে না, সেটাও তিনি স্বীকার করেছেন।

এডিজি-র কথায়, ‘‘বাংলাদেশ কাছে হওয়া সত্ত্বেও ওই জলপথ অরক্ষিত। এতদিন সত্যিই এ নিয়ে ভাবা হয়নি। তার সুযোগ নিয়েছিল জেএমবি জঙ্গিরা। কারণ ওই পথে অনুপ্রবেশকারীদের যাতায়াত বেশি। আর তাই, ওই সব এলাকাতেই জেএমবি জঙ্গিরা নিজেদের ডেরা বানিয়ে ফেলতে পেরেছে।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE