কোথায় করোনা! হর কী পৌড়ীতে গঙ্গা আরতি। মানা হচ্ছে না কোনও কোভিড-বিধি। রবিবার হরিদ্বারে। পিটিআই
আমাদের ছোটবেলায় কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেই একবার কুম্ভমেলায় খোঁজ করলে নির্ঘাত পাওয়া যাবে, এ রকম একটা স্তোকবাক্য খুব চালু ছিল। তার পর যখন পৃথিবীর সব খোঁজই আঙুলের টোকায় তিরিশ সেকেন্ডের ভিতর শেষ হয়ে যেতে শুরু করল, তখন থেকে কেউ আর কারও খোঁজ করে না বিশেষ। লুঠ হতে থাকা দোকানের ভিতর দাঁড়িয়ে একটা বাচ্চা সবার ঝোলার ভিতর থেকে পড়ে যাওয়া স্বস্তির কণা কুড়িয়ে নিচ্ছিল, গল্পে পড়েছি; আজ যখন প্রায় সবাই একটু স্বস্তিই খুঁজছে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে বা না-দাঁড়িয়ে তখন স্নান কি পরিত্রাণের অন্য নাম হতে পারে?
নিরঞ্জনী আখাড়া, জুনা আখাড়া, শ্রীপঞ্চ অটল আখাড়া— আরও কত আখাড়ার প্রস্তুতির ভিতর দিয়ে কেটে যাবে আজকের রাত। কাল যে শাহি স্নান! বৈষ্ণবী আখাড়ার সাধুরা যাবেন একভাবে, শৈব আখাড়া বা উদাসীন আখাড়ার সাধুরা যাবেন অন্য ভাবে। যত মত তত পথ। কিন্তু তার জন্য অনেকগুলো পথ খোলা থাকা তো জরুরি! প্রশাসন তো এই করোনার আবহে স্নানে যাবার রাস্তা কমিয়ে দিচ্ছে। প্রশাসনেরই বা উপায় কী? অন্যান্য বার বারো কোটি থেকে থেকে পনেরো কোটি পুণ্যার্থী ডুব দেন কুম্ভে। এবার এই অতিমারির আবহেও সংখ্যাটা তিন-চার কোটির কম হবে না। ‘‘মনে ঢেউ নেই, জলে ঢেউ খুঁজতে এসেছে,’’ বলতে বলতে ভিড় থেকে আলাদা হয়ে গণেশ ঘাটের দিকে তরতর করে হেঁটে যাচ্ছেন দেখলাম একজন। কৌতূহলবশত পিছু নিলাম তাঁর।
বহু বছর আগে কাশীতে এক সাধুকে দেখেছিলাম ভিক্ষে নিয়ে খানিকটা ভিক্ষে গৃহস্থকেই ফিরিয়ে দিতে। যে দিচ্ছে সে-ও যে নিজের কিছু দিচ্ছে না, এই বোধ জাগ্রত করানোর লক্ষ্যেই নাকি এমনটা করতেন তিনি। ‘ব্যক্তিগত মালিকানার’ বোধে কুঠারাঘাত করে ব্যক্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না? মনের প্রশ্ন মনেই রইল, সাধু মহারাজ মাটি দিয়ে শিবলিঙ্গের আদল তৈরি করতে করতে বলে গেলেন, “সংসার ত্যাগই তো স্নান। আর যে ত্যাগ করে এসেছে, তার ঘাটে গেলেও যা, না গেলেও তাই।”
থমকে গেলাম এক মুহূর্ত। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তাঁর এক প্রিয় শিষ্যকে বলেছিলেন, “পায়খানায় গিয়ে জপ করিস না কেন, আমি ওখানে নেই?”
“সাইড দিজিয়ে, সাইড দিজিয়ে!” শুনে যতটা সম্ভব সরে গিয়ে দেখলাম, দু’জন মাতাজি একটি সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এগিয়ে চলেছেন এবং কেউ ছবি তুলছে দেখলেই চালককে গাড়ি থামাতে বলছেন। তাঁদের পিছুপিছু হেঁটে আসা দু-তিন পিস ছোকরা সিটিও দিল বেশ কয়েক বার। মাতাজিরা অবশ্য ভ্রূক্ষেপহীন। দেহরাদূন থেকে খানিকটা এগোতেই গাড়ির উপর নিষেধাজ্ঞা। অটো পাল্টে পাল্টে আসার পথে জিনস পরা অসংখ্য মেয়ে। এখানেই সেই জিনস-এর ভালমন্দ নিয়ে কথা উঠেছিল না? নির্বিকার এক তরুণীর মন্তব্য, “লোগ বোলতে রহতে হ্যায়, হাম করতে রহতে হ্যায়!”
মাতাজিদের থেকে চোখ ফেরাতেই দেখি, সেই একলা হয়ে যাওয়া সাধু শক্তিপীঠের উপর শিবলিঙ্গ স্থাপনা করে ফেলেছেন প্রায়। জটায় জাহ্নবীকে ধারণ করায় সতী যখন ক্ষুব্ধ, তখন তাকে অঙ্গে নিয়ে অর্ধনারীশ্বর হয়ে ওঠেন শিব। ‘এন্ড্রোজিনি’ সভ্যতা যদি কখনও আত্মপ্রকাশ করে, তার প্রথম পূজ্য বোধহয় তিনিই হবেন। ওই রূপ নেওয়া মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে পড়ছিল, যে রক্ত কাল টিভির পর্দায় দেখে এসেছি, মাটি থেকে তাকে ধুইয়ে দিতে পারে কেবল জল।
কুম্ভমেলা তো সেই জলেরই উৎসব। মানুষের অস্তিত্বে জমে থাকা যে অপরাধবোধ বর্ণমালার ‘অ’কে জড়িয়ে দেয় ‘অজগর’-এর সঙ্গে, গলায় সাপ জড়িয়ে নিয়েই হয়তো তার বিষপান করতে হয়, করে যেতে হয়।
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে মারতে না পারলে অমৃতের অপেক্ষা ফুরোবে কী ভাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy