কুম্ভ-স্নান: সোমবার হরিদ্বারে নাগা সাধুরা। রয়টার্স
আমি এক বার শিকাগো এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে আমার আমন্ত্রণকর্তাদের বলেছিলাম, শিগগির আমায় উদ্ধার করতে, বিমানবন্দরে আগুন লেগেছে। উত্তরে এক সাহেব আমায় বিমানবন্দরের বাইরের রাস্তায় কোনও গাছের তলায় গিয়ে বসতে বলেছিলেন। কারণ, আগুন তো আর আমার গায়ে লাগেনি। কে ঠিক কোন অবস্থাকে ‘ইমার্জেন্সি’ হিসেবে দেখেন, তার ভাল আন্দাজ পেয়েছিলাম সে দিন। হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় এসে করোনা নিয়ে খুঁতখুঁতুনি করলেও কী উত্তর পাওয়া যাবে, তা বলার আগে এটা বলা উচিত যে পুলিশ-প্রশাসনের তরফ থেকে একটা চেষ্টা আছে; মাস্ক-বিলি, স্যানিটাইজ করার উদ্যোগ এ দিক-ও দিক তাকালেই চোখে পড়বে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হওয়ার জো নেই। কারণ, জনতার ভ্রূক্ষেপ নেই। করোনার দ্বিতীয়-তৃতীয় ঢেউয়ের বিপ্রতীপে মানুষের অন্তহীন ঢল ‘ চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ হয়ে আছড়ে পড়ছে ঘাট থেকে ঘাটে। মধ্যপ্রদেশের রেওয়া থেকে, বিহারের আরা থেকে, উত্তরপ্রদেশের এটাওয়া থেকে, হরিয়ানার পানিপথ থেকে পায়ে হেঁটে কত মানুষ যে এসেছেন, আসছেন তার ইয়ত্তা পাওয়া যাবে না। এসেছেন বলেই গত তিন মাস ধরে প্রচুর কর্মসংস্থান হয়েছে হরিদ্বারের হোটেলে, ধাবায়, ঘাটেও, তবু...
‘‘একশো তিরিশ কোটি লোকের মধ্যে ক’কোটি মরেছে যে কুম্ভ বন্ধ করে দিতে হবে?” এক জন সর্দারজি বললেন। তাঁর পিছনে আরও প্রায় চল্লিশ জন শিখের একটি দল।
বাপরে! ‘ইমার্জেন্সি’ বিষয়ে খুবই উচ্চ-বিচার দেখছি। কিন্তু তর্কে না গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘শিখরাও আসেন কুম্ভে?’’ তিনি ফুঁসে উঠলেন,
‘‘কিছুই জানো না দেখছি। গুরু নানকদেবজীর ছেলের দৌলতেই কুম্ভের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা শিখরা আর কোথাও প্রকাশ্যে পাগড়ি খুলি না একমাত্র এই কুম্ভে স্নান করার সময় ছাড়া।’’
কিন্তু এই সময় এখানে স্নান করা কি নিরাপদ? — আরে ডরপোক, এত মরার ভয় থাকলে কুম্ভে আসতে নেই। আর তোমার ভয় কাকে, করোনাকে? তুমি জানো না, করোনা কালার সে ডরতা হ্যায়? আর দেখো আমরা সবাই কত রকম পাগড়ি পরেছি, ব্লু, ইয়েলো, রেড।
‘‘কোনও ভাইরাস আসবে না, চলো স্নান করতে।’’ অন্য এক সর্দার বললেন। বিজ্ঞানের এ রকম ক্লাসে হয়তো হাসাই উচিত কিন্তু আমার দেশের মানুষের সারল্যে কান্নাও পায় আমার। ‘জো বোলে সো নিহাল/ সত শ্রী অকাল’ বলে সরে এলাম ওঁদের দলটার থেকে। ওঁরা ‘হর হর মহাদেব’ বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন।
সোমবার ভোররাত্রি থেকে অসংখ্য সাধুকে এগিয়ে যেতে দেখলাম গঙ্গার দিকে, একা কিংবা দলবল সহ। “ যাঁর গায়ে যত ছাই তিনি তত বড় সাধু” এক জনের মুখে শুনলাম। অন্য কেউ আর এক রকম বলবেন হয়তো। পঞ্চভূত, পাঁচফোড়ন, পঞ্চব্যঞ্জন। দুধ-দই-ঘি-মধু- চিনি মাখিয়ে শিবকে স্নান করায় পাঁচ আঙুল। কেউ কারও সমান নয়, এক ছাঁচে ঢালা নয় কিছুই। বৃন্দাবনে ‘রাধে-রাধে’, পুরীতে, ‘জয় জগন্নাথ’, অমৃতসরে, ‘ওয়াহ্, গুরুজি কি ফতে’। ‘কোস কোস মে পানী বদলে, চারকোস মে বাণী’।
গন্ধরসের বিপুল আয়োজনে পুষ্ট ডিজাইনার সন্ন্যাসীর খোলা গাড়ির পাশেই হেঁটে চলেছেন কৌপীন পরা অসংখ্য সাধু। সর্বহারা না সর্বত্যাগী কে বলবে? তবু তারই ভিতরে এক জনের ধুনির সামনে আটকে গেলাম কিছুক্ষণ। নগ্ন সেই সন্ন্যাসীকে টাকা দিতে এসে বকুনি খাচ্ছেন দু’জন।
“শরীরে একটা সুতো রাখিনি, পয়সা রাখব কোথায়?”
বহু দিন, বহু যুগ পর কাউকে এগিয়ে দেওয়া টাকা প্রত্যাখ্যান করতে দেখে উল্লাসে ভরে উঠল মন। কিন্তু তার ভিতরেও খচখচ করছিল, সর্দারজির ওই সম্বোধন।
মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়া তো সহজ, বেঁচে থেকে তিলে তিলে সব সহ্য করাই কঠিন। কিন্তু আমার যাতে বিপদ আছে মনে হয়, অসংখ্য মানুষের কাছে তাই বিপদতারণ। এ বার আবেগতাড়িত হয়ে আমি কিছু করলেও যুক্তি থাকবে যুক্তির জায়গাতেই।
‘‘আমি তোমারটা মানব কেন?” পরস্পরকে বলতে বলতে এগিয়ে গেল দুই যুবক-যুবতী।
তেরে মনকি গঙ্গা, মেরে মনকি যমুনা...
পরস্পরকে শোনা, জানা, চেনা, হয়তো কিছুটা মানার মধ্যেই সম্মিলন।
চৈত্রের খর রোদেও ‘অনন্ত ফাল্গুনী’ জাগিয়ে রেখে গঙ্গাও তাই হয়তো আকাশকে বলছে, “ তুমি যেন বলো আর আমি যেন শুনি”...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy