ডাংরির বাড়ির দেওয়ালে ছবি প্রিন্স ও দীপক শর্মার। নিজস্ব চিত্র
পাহাড় আর অরণ্যে ঘেরা এই গ্রামে পাখিও কাঁদে নিহত যুবকদের শোকে। বৃক্ষ, ফল পাতা জানতে চায় কারা সেই সন্ত্রাসী?
স্বগতোক্তির মতো করে ঠিক এ কথাই জানালেন রাজৌরি জেলার কুখ্যাত হয়ে যাওয়া ডাংরি গ্রামের জঙ্গি হামলায় নিহত একুশ আর তেইশের দুই যুবা দীপক আর প্রিন্স শর্মার মা সরোজবালা। এক বুক শূন্যতা নিয়ে যিনি বিচারের অপেক্ষা করে আছেন এক বছর দশ মাস ধরে। পাহাড়ের মাথায় তাঁর বাড়ির ঘরগুলোয় রুক্ষ হাওয়ার যাতায়াত। মেধাবী, অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করা দুই ছেলের বইপত্র, টেবিল, আসবাব যেমন ছিল ঠিক তেমনই ঝকঝকে করে রাখেন যিনি প্রত্যহ।
আগামী ২৫ তারিখ ভোট এই বিধানসভা কেন্দ্রে। সন্তানহারা মা একটানা বলে গেলেন, “রাস্তা আটকে বসে যাব ওই দিন বুথের সামনে, ছেলেদের পোস্টার হাতে নিয়ে। নিজেরা তো ভোট দেবই না, বাকিদেরও বলব না-দিতে। আমার সঙ্গে আরও সন্তানহারা এবং প্রতিবন্ধী ছেলের পরিবার রয়েছে। আমি নিজে কোথায় না মাথা ঠেকিয়েছি বিচার চেয়ে। এখানকার থানা থেকে দিল্লিতে অমিত শাহের অফিস পর্যন্ত। অমিত শাহ বলেছিলেন, আমার দুই ছেলের মৃত্যুর বিচার নিয়ে আর আমাকে ভাবতে হবে না, এটা ওঁর নিজের মামলা। কিন্তু শাহ ছেড়ে দিন এখানকার বড় বিজেপি নেতা রবীন্দ্র রায়নাও এই গ্রামে এসে ভোটের সভা করলেও এক বারও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি।” জানা গেল নিস্তরঙ্গ এই গ্রামে আচমকা জঙ্গি হামলার পরে যখন আতঙ্ক এবং শোকের স্রোত বইছে, জম্মু ও কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল এসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজও শনাক্ত করা যায়নি কে ওই নৃশংস হামলা চালিয়েছিল, কোনও সংগঠন দায়ও স্বীকার করেনি।
সরোজবালার বাড়ির সামনে এবং গ্রামের কিছু বিন্দুতে অষ্টপ্রহর অস্থায়ী সেনা পোস্ট বসেছে, ২০২৩ সালের ১ এবং ২ জানুয়ারির ওই নৃশংস হামলার পরে। কেন্দ্রীয় সরকার সামনেই হ্যান্ডপাম্প লাগিয়ে দিয়েছে যাতে সরোজবালা এবং ভুক্তভোগী পরিবারগুলির সদস্যদের নীচে গিয়ে না জল সংগ্রহ করতে হয়। আইডি বিস্ফোরণে দেওয়ালে যা ক্ষতি হয়েছিল সেগুলি মেরামত করে দেওয়া হযেছে। তবু আঙুল দিয়ে নির্দেশ করলেন মা, “দেখুন চুনকাম করলেও এখনও আমার বাচ্চাদের রক্ত লেগে আছে।”
যতটা না দেওয়ালে, তার তুলনায় রক্ত বেশি লেগে রয়েছে এই গ্রামের মনে। কী ভাবে জঙ্গিরা এই গ্রামে ঢুকে নিরপরাধ যুবক-শিশুদের বুকে শিসা ঢেলে, জঙ্গলে ফিরে না গিয়ে পাহাড়ি পথে শহরের দিকে নেমে গেল, সে ধাঁধার সুরাহা হয়নি। “শীতের সময়ে এমনিতেই বিকেল ছোট। কিন্তু তখনও বেশ আলো ছিল। আমি গরু খুঁটিতে বেঁধে বাড়ির পিছন দিকে যাওয়ার সময়েও ওদের দেখে গিয়েছি। বাড়ির সামনে ওরা মোবাইলে এক অন্যের ছবি তুলছিল। গরু বেঁধে সামান্য দূরে মন্দিরে পৌঁছতেই একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ, কেউ যেন কারও টুঁটি চেপে ধরেছে। তার পরে গুলির আওয়াজ আমাদের বাড়ির দিক থেকেই। আমাদের সঙ্গেই থাকে ভাইপো। সে দৌড়ে নীচে নামতেই গুলি খায় পেটে। যন্ত্রণার মধ্যেই দেখে ছেলেদের মেশিনগান দিয়ে গুলি করে বাঁট দিয়ে মারছে মুখোশপরা দুটি লোক আর খোলা দরজা গিয়ে বাড়িতে ঢুকছে,” এক নিঃশ্বাসে বলছেন সরোজবালা। “আমি পুরোপুরি বুঝিনি কী হচ্ছে, শুধু বুঝেছিলাম যম এসে দাঁড়িয়েছে। পিছনের লাগোয়া একটা কাঠকুটো জ্বালার ঘর ছিল, সেখানে ঢুকে খিড়কি দিয়ে মুখচাপা দিয়ে বসেছিলাম। সামনে পর্যন্ত বুটের আওয়াজ এসে আবার ফিরে গেল। আরও খানিকক্ষণ পরে সব নিঝুম হয়ে যাওয়ায় বেরিয়ে দেখি যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে। চাতালে জুড়ে আছে আমার দুই ছেলে। ভাইপো তখন কাতরাচ্ছে।” সেই ভাইপো রোহিত শর্মাই আজ সম্বল সরোজবালার। জলবণ্টন দফতরে কাজ করা স্বামী গত হয়েছিলেন কোভিডের আগেই। এখন এই ফাঁকা ঘর বাড়ি জমিজমার মধ্যে রোহিতকে নিয়ে বসে থাকেন তিনি। প্রতি দিন নতুন করে চিঠি লেখেন পুলিশ, সরকারি কর্তা, রাজনৈতিক নেতাদের।
রোহিত জামা তুলে দেখালেন পেটে ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন। প্রাণে বেঁচেছিলেন কিন্তু কোনও ভারী কাজ করতে পারেন না আর। বললেন, “ওরা একটু অচেনা ভাষায় কী কথা বলছিল বুঝিনি। আমিও আর বাঁচব না ভেবে হয়তো আর গুলি চালায়নি। নেমে রাস্তার দিকে চলে গেল।” সে দিন পুলিশ আসে প্রহরা শুরু হয়। কিন্তু পর দিন আবার এই গ্রামে বিস্ফোরণে পাঁচ জনের মৃত্যু ঘটে। আজ যার জেরে আজীবন বিছানায় শুয়ে থাকবে জনা সাতেক প্রতিবন্ধী কিশোর যুবা।
রাজৌরি, কাঠুয়া, রিয়াসি, পুঞ্চের মতো জায়গাগুলি এখন সন্ত্রাসের নতুন মঞ্চ, যাকে হিসাবে রেখেই ভোটের চাল চালছে এক দিকে বিজেপি এবং অন্য দিকে এনসি-কংগ্রেস। তবে যে দলই জিতুক এই গ্রামটি যে এ বার ভোটের উৎসবে শামিল হবে না, সে কথা এখানকার গ্রামবাসীরা সাফ জানিয়ে দিলেন। এবং সন্ত্রাসের এমন বাড়বাড়ন্ত চলতে থাকলে শুধু এই গ্রাম নয়, গোটা এলাকাতেই কিছুটা জাঁকিয়ে বসা বিজেপি-র ভবিষ্যৎ-ও যে খুব উজ্জ্বল নয় তা ঘরোয়া ভাবে জানাচ্ছেন স্থানীয় সরপঞ্চেরা।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আজই ফিরতে হবে এই অভিশপ্ত গ্রাম থেকে জম্মু শহরে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। নীরবতাই খড়কুটো যেখানে। উঠে দাঁড়ালাম দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দিকে পা বাড়ানোর জন্য। সন্তানহারা মা আমাকে পেরিয়ে দূরে কিছু দেখছেন যেন, “এই জমিজমা সব পড়ে আছে। এ সব তো ওদের জন্যই ছিল। আমি শেষ বিচারের জন্য অপেক্ষা করছি শুধু। জানেন তো এখানে পাখিও কাঁদে ওদের দুঃখে। গাছ, ফল, পাতা জানতে চায় কারা এই সর্বনাশ করল আমাদের? কবে এর বিচার হবে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy