শঙ্করপুরে ঢেউয়ের দাপটে ভেঙেছে পাড়। ছবি: কেশব মান্না
বৃহস্পতিবার মাঝরাতের ঠিক আগে কিছু ক্ষণের জন্য সব কিছুই কেমন থমকে গিয়েছিল। বৃষ্টি নেই, হাওয়া নেই, কিচ্ছু না! ভাবছিলাম, তবে কি কিছু ঘটবে না, বেঁচে গেলাম! ফোন করে ধামরা, কেন্দ্রাপড়ায় পরিচিতদের থেকে খবরও নিচ্ছিলাম। এর ঠিক পরেই দানা স্বমূর্তি ধারণ করল।
ভিতরকণিকা ন্যাশনাল পার্কের ঠিক বাইরে দাঙ্গামাল গ্রামে আমার বাড়ি। শোঁ শোঁ হাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, এটা কি ১৯৯৯-এর সুপার সাইক্লোনকেও ছাপিয়ে যেতে চলেছে। আমি তো বলব, আমাদের ভিতরকণিকার ম্যানগ্রোভ যে মানুষের কত বড় বন্ধু, সেটাই দানা এসে দেখিয়ে গেল। বন দফতরের কর্তা, সরকারি অফিসারেরা পরে অবশ্য বললেন, যা ভাবা গিয়েছিল তার থেকে অনেকটা কমজোর ছিল দানা। এবং দানাকে বশ মানিয়ে দুর্বল করে তোলায় বড় ভূমিকা এই ম্যানগ্রোভের।
আমি নিজের রেস্ট হাউস নিয়ে থাকি। প্রকৃতিকে ভালবাসি। এই ৫৩ বছর বয়সে আমার বার বার মনে হচ্ছে, ম্যানগ্রোভের গুরুত্ব বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকদের সচেতন করতে ওড়িশা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আরও বেশি তৎপর হওয়া উচিত। এ বার দানা স্পষ্ট দেখাল, ম্যানগ্রোভ আছে বলেই আমরা আছি! রাত দেড়টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সব থেকে প্রবল ছিল দানার দাপট। তবে যা শুনেছি, গতিবেগ সাধারণত ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারই ছিল। বিক্ষিপ্ত ভাবে ১২০ কিলোমিটার হয়েছিল। তখন ভয় পেলেও কোনও সন্দেহ নেই, ১৯৯৯-এর বিভীষিকার পাশে এ কিচ্ছু নয়।
খবর পেয়েছি, দানা মাটি ছুঁয়েছে ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে সমুদ্র লাগোয়া হাবালিখাটি নেচার ক্যাম্পে। ওখানে আর কিছু দিন বাদেই ভারত মহাসাগর পারের অলিভ রিডলিরা এসে ঘাঁটি গাড়ে। তখন পর্যটকেও ভরে যায়। পাঁচটা তাঁবু, চারটে পাকা ঘর রয়েছে। কয়েক দিন আগে লক্ষ্মীপুজোর পূর্ণিমার জলোচ্ছ্বাসে ওখানে ১০-১২টা কাচের জানালা ভেঙে যায়। রেস্ট হাউসের ফরেস্ট গার্ডের বাড়ি সমুদ্র থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে। তাঁকে অবশ্য প্রশাসন আগেই নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে বলেছিল। এটা স্বস্তির, ল্যান্ডফল যেখানে হয়েছে, সেখানে জনবসতি নেই। ম্যানগ্রোভের দক্ষিণ-পশ্চিমেই প্রধানত ঝোড়ো হাওয়া ধাক্কা মারে। অরণ্যের পিছন দিকে তা আঘাত করে। আমরা ভয়ে ছিলাম, এখন ম্যানগ্রোভের উঁচু ডালে ৮০০০ রকমের পাখি এসে ডিম পাড়ে, ছানাদের বড় করে। আমরা সৌভাগ্যবান, ম্যানগ্রোভেরও বিশেষ ক্ষতি হয়নি। নইলে পাখিরা উদ্বাস্তু হত। ছানাদের বিপদ হত।
যা জানতে পেরেছি, বেশ কিছু ঝাউ, শাল, সেগুন এমনকি, আমাদের গ্রামের নারকেল গাছ পড়েও রাস্তা বন্ধ হয়েছিল। বেশির ভাগ রাস্তাই আজ বৃষ্টির মধ্যে সাফ করা হয়েছে। আমাদের দাঙ্গামাল গ্রামে অন্তত ৫০০ লোক সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। আমার রেস্ট হাউসেও রয়েছেন ৩০-৪০ জন। সবার জন্য ভাত, ওড়িশার প্রচুর আনাজ দেওয়া ডাল ডালমা, আর আমের আচার তৈরি করে খেতে দিচ্ছি। ভয়ানক বৃষ্টি এবং হাওয়ায় এ দিক-ও দিক দিয়ে ডালপাতা এসে আমাদের ছাদে পড়ে জল জমেছিল। সব পরিষ্কার করতে হল।
বৃহস্পতিবার রাত ১টা থেকে বিদ্যুৎ নেই। তবে আমার ইনভার্টার রয়েছে। পাশে পঞ্চায়েত অফিসেও জেনারেটর ভরসা। ওড়িশায় দুর্যোগ আমরা বছর, বছরই দেখে থাকি। তবে ১৯৯৯ ছাড়া আমাদের ছেলেবেলায় ১৯৮২-এর কথা বিশেষ করে মনে পড়ছে। তখন আমাদের গ্রামে একটাও পাকা ঘর ছিল না। সর্বত্র নোনা জল ঢুকে সে কী অবস্থা! বার বার মনে হয়, এখন বিপদ এলেও আমরা সহজে হার মানি না। বরং সবাই সবার পাশে আছি, এ দুর্যোগেই তা ভাল করে বোঝা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy