গয়ায় নরেন্দ্র মোদী। রবিবার রঞ্জিৎ দে-র তোলা ছবি।
সব ভোট একসঙ্গে করার চেষ্টার গোড়াতেই হোঁচট খেতে হল নরেন্দ্র মোদী সরকারকে। পাঁচ বছরে একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট করানোর প্রস্তাবে আপত্তি তুলল অনেক বিরোধী দল। বিরোধিতায় সামিল পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূলও।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরেই সব ভোট পাঁচ বছরের সময়সীমায় বেঁধে দেওয়া নিয়ে তৎপর হয়েছেন। যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, এই ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে ফি-বছর হরেক রকমের ভোটের হাত থেকে নিস্তার পাবেন সাধারণ মানুষ। ভোটের পিছনে যে বিপুল খরচ হয়, যেটি আখেরে আম জনতার পকেট থেকেই আসে, তাতেও সাশ্রয় হবে। আর ভোটে আদর্শ আচরণবিধি মেনে চলতে গিয়ে উন্নয়নের কাজ যে ভাবে থমকে যায়, রেহাই পাওয়া যাবে, তার হাত থেকেও। এই প্রস্তাবের পক্ষে সওয়াল করছেন যাঁরা, তাঁদের যুক্তি, পাঁচ বছর অন্তর ভোট বেঁধে দেওয়া গেলে সরকারের স্থিরতাও আসবে। কী ভাবে পাঁচ বছরে একসঙ্গে লোকসভা ও সব রাজ্যের বিধানসভার ভোট করা যায়, তার একটি সবিস্তার প্রস্তাবও দিয়েছে নিবার্চন কমিশন। কিন্তু বাদ সেধেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল। এমনকী কংগ্রেস, এনসিপির মতো দলও সরাসরি এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব রাজনৈতিক দলগুলির কাছে এই বিষয়ে যে মতামত চেয়েছিলেন, তার লিখিত জবাব দিয়েছেন তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী। সূত্রের মতে, সেই লিখিত জবাবে তৃণমূলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাজ্যের পঞ্চায়েত ও পুরসভার ভোট একসঙ্গে করা যেতে পারে। কিন্তু লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে করার প্রস্তাব শুনতে ভাল লাগলেও বাস্তবে তা সম্ভব নয়।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাজ্যগুলি মোটেই কেন্দ্রের অধীনে নয়। সংবিধানেও এর স্বীকৃতি দেওয়া রয়েছে। ফলে রাজ্য চালানোর ব্যাপারে কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ থাকতে পারে না। তাই কেন্দ্র রাজ্যের বিধানসভা ভোটের মেয়াদ বাড়াতে বা কমাতে পারে না।
আসলে পাঁচ বছর অন্তর একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট করানোর জন্য নির্বাচন কমিশন পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছে। এক, লোকসভা ও সব রাজ্য বিধানসভার মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। এখন সংবিধানে বলা আছে, আগে পতন না হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত মেয়াদ থাকবে সরকারের। দুই, যদি এই মেয়াদের আগে কেন্দ্রীয় সরকার পড়ে যায়, তা হলে রাষ্ট্রপতি একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন এবং এই মন্ত্রিসভার পরামর্শে পাঁচ বছরের বাকি মেয়াদ দেশ চালাবেন। তিন, যদি বাকি মেয়াদের সময়টি দীর্ঘতর হয়, তা হলে নতুন করে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পাঁচ বছর সম্পূর্ণ হতে যে টুকু সময় বাকি থাকবে, সেই পর্যন্তই সরকার বহাল থাকবে। চার, ভোটের পর যদি কোনও রাজনৈতিক দলই সরকার গড়তে না পারে, তা হলেও নতুন করে ভোট হবে। কিন্তু সেই সরকারও ওই আগের হিসেবে পাঁচ বছর পর্যন্তই বহাল থাকবে। পাঁচ, কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধির মৃত্যু হলে বা আসন কোনও কারণে খালি হলে উপনির্বাচন হতে পারে। কিন্তু সব উপনির্বাচন করানোর জন্য বছরে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এই যাবতীয় ব্যবস্থা কার্যকর করতে সংবিধানের ৮৩, ৮৫, ১৭২, ১৭৪ ও ৩৫৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু এখানেই আপত্তি তুলছে রাজনৈতিক দলগুলি। যেমন তৃণমূলের বক্তব্য, সামনের বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। আর লোকসভা নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে। এই প্রস্তাব মানতে হলে তো আগামী তিন বছর পশ্চিমবঙ্গে কোনও নির্বাচিত সরকারই থাকবে না! নির্বাচন কমিশনের সূত্রের মতে, এ সব ক্ষেত্রে দেশের রাজ্যগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একটি শ্রেণি, যে সব রাজ্যে ছ’ মাসের মধ্যে ভোট। আর একটি শ্রেণি, যাদের ভোট ছ’মাসের বেশি সময় থেকে শুরু করে তিন বছরের মধ্যে। সব শেষের শ্রেণিটি হচ্ছে, যে সব রাজ্যে ভোট তিন বছরের বেশি সময় পরে
হওয়ার কথা।
কমিশনের বক্তব্য, এক বার প্রক্রিয়াটি চালু হলে গোটা ব্যবস্থা কাযর্কর করতে ৩-৪ বছর লেগে যাবে। লোকসভা ও সব রাজ্যের ভোট করাতে কমিশনেরই ৪৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়। এর পরেও রাজনৈতিক দলগুলির বিপুল বহরের খরচ আছেই। একসঙ্গে ভোট হলে খরচের পরিমাণ এক ধাক্কায় অনেকটা কমে যাবে। বারবার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের ঝক্কিও থাকবে না। মানুষও নানা দিক থেকে রেহাই পাবে।
কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি একমত হলেই সংবিধানের এই সব অনুচ্ছেদকে সংশোধন করা সম্ভব। তবে অনেক দলই মনে করে, কমিশন যে সব প্রস্তাব দিয়েছে— যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের পতন হলে রাষ্ট্রপতি নিজের মন্ত্রিসভা গঠন করে দেশ চালাবেন- এমন ভাবনা দেশের গণতন্ত্রের জন্য বিপদের বার্তা দিতে পারে। আর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সব প্রস্তাব নিয়ে কতটা আলোচনা হতে পারবে, তা নিয়েও সন্দেহ থাকছে।
বিশেষ করে কংগ্রেস মোদী সরকারের উপরে যে ভাবে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে, তাতে সরকারের কোনও প্রস্তাবেই সাড়া দেওয়ার অবস্থায় তারা নেই। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জনার্দন দ্বিবেদী তাই অনেকটা দায়সারা ভাবেই একে ‘সংবিধান বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে মোদী সরকারের প্রস্তাব সটান খারিজ করে দিয়েছেন। একই মনোভাব নিয়েছে শরদ পওয়ারের দলও। তবে এনডিএর শরিক অকালি এবং বিজেপির ‘বন্ধু’ দল এডিএমকে-র নেত্রী জয়ললিতা এই সব প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। যদিও তাঁরা কয়েকটি সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলে সেগুলিকে সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy