ছিঁড়ে যাওয়া চেক হাতে সুখদেও যাদব। —নিজস্ব চিত্র।
১৫০, ১৬০, ১৮০, ২০০, ২১০-২১০-২১০!
নিলাম শেষ হতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুভাষ দাতির।
শীতের সকালে পরম মমতায় ট্রাক্টরের পেঁয়াজের গায়ে হাত বোলাচ্ছিলেন এতক্ষণ। নিলামে প্রতি কুইন্টালে মাত্র ২১০ টাকা দর উঠল সুভাষের আনা পেঁয়াজের। অর্থাৎ কেজিতে ২ টাকা ১০ পয়সা। ‘‘কী হবে এ দিয়ে? কেজিতে ৭ থেকে ৮ টাকা চাষের খরচ।’’
ক’দিন আগেই সতনার দুই চাষি— রবীন্দ্র বিরারি ও প্রশান্ত মহাজন ৩০ কুইন্টাল পেঁয়াজ রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। ঘরে রাখার জায়গা নেই। বাজারে বেচতে গেলে লোকসান। সুভাষ তা পারেননি। ‘‘পেঁয়াজ চাষ করেই পেট চলে। রাস্তায় ফেলে দিই কী করে?’’
বাগলানের তত্যাভাও খৈরনার নিজের গুদামে ৫০০ কুইন্টাল পেঁয়াজ মজুত করেছিলেন। ভেবেছিলেন, ভাল দামে বেচে ১১ লক্ষ টাকা দেনার অনেকটাই শোধ হবে। কিন্তু পেঁয়াজ থেকে যায় গুদামবন্দি। সপ্তাহ দুয়েক আগে পেঁয়াজের গুদামেই গলায় দড়ি দিয়েছেন খৈরনা।
আরও পড়ুন: তন্দুরে মুক্তির নির্দেশ
খৈরনারের মতো বাগলানের মনোজ ঢোন্ডগের সঙ্গেও পরিচয় ছিল সুভাষের। মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই মনোজের মাথায় ১২ লক্ষ টাকার দেনা চেপেছিল। গলায় কীটনাশক ঢেলে পেঁয়াজ খেতেই শুয়ে পড়েছিলেন মনোজ।
সুভাষ দাতিরের দুই ছেলে, এক মেয়ে। সন্তানদের মুখ চেয়ে তিনি ‘ও সব’ করতে পারেননি। লোকসান হবে জেনেও পেঁয়াজ নিয়ে এসেছেন লাসলগাঁওয়ে।
লাসলগাঁও— দেশে পেঁয়াজের সবথেকে বড় পাইকারি বাজার। নাশিক জেলার অধিকাংশ পেঁয়াজ এই বাজারে নিলামে ওঠে। গরমের সময় এখানে যে পেঁয়াজ ফলে, তার ঝাঁজ ও খুশবু রান্নায় না মিশলে আরবের শেখদের খানা মুখেই রোচে না। দুবাই থেকে গোটা আরব, ওমান, কাতার, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার রান্নাঘরেও এই পেঁয়াজই পয়লা পসন্দ্। এর বড় গুণ, মাসের পর মাস বস্তায় ভরে রাখলেও সহজে পচে না।
সেই লাসলগাঁওয়ের পেঁয়াজ চাষিদের মুখে হাসি নেই। লাসলগাঁও কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটির কর্তা শিবনাথ যাদব জানান, বছরের শুরুতে পেঁয়াজ বেচে কেজিতে ২৮ টাকা পর্যন্ত মিলেছিল। তারপরে দাম নামতে শুরু করে। পরে দর উঠবে ভেবে পেঁয়াজ মজুত করে রেখেছিলেন চাষিরা। কিন্তু এখন তা ১-৪ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তার মধ্যে বাজারে চলে এসেছে শীতের নতুন পেঁয়াজ।
কেন দর মিলছে না? ব্যবসায়ী সুরিভান বারকে লাসলগাঁও থেকে পেঁয়াজ কিনে মুম্বই পাঠান। সেখান থেকে তা আরবের জাহাজে ওঠে। তাঁর আঙুল দিল্লির সরকারের নীতির দিকে। ‘‘দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়লেই সরকার যখন-তখন রফতানি বন্ধ করে দেয়। আমরা অগ্রিম টাকা নিয়ে বিদেশে পেঁয়াজ পাঠাতে পারি না। এই সুযোগে পাকিস্তান সস্তায় পেঁয়াজ বেচছে ইসলামি দেশগুলোতে।’’
শুধু ইমরান খানের দেশ যে নাশিকের চাষিদের রুটিরুজিতে হাত দিয়েছে, তা নয়। নাশিকের চাষিরা পেঁয়াজ ফলিয়ে লাভ করছেন দেখে কর্নাটক, গুজরাতেও বিপুল পেঁয়াজ চাষ হচ্ছে। ফলে ওইসব রাজ্যেও পেঁয়াজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। লাসলগাঁওয়ের বাজারেই চাষিদের থেকে কেনা পেঁয়াজে গাছ গজিয়ে যাচ্ছে। সুরিভানের প্রশ্ন, ‘‘দেশে কি কোনও কৃষি নীতি নেই? যে যেমন খুশি চাষ করবে? এ বছর চাষিরা দর পাচ্ছেন না। খরা লেগেছে। পরের মরসুমে পেঁয়াজ মিলবে না। তখন আবার দর আকাশ ছোঁয়া হবে।’’
তবে মহারাষ্ট্রের এই পেঁয়াজ চাষি ও ব্যবসায়ীরা সব দলের কাছেই ভোটব্যাঙ্ক। আর উত্তরপ্রদেশের পরেই মহারাষ্ট্রে লোকসভা আসন সবথেকে বেশি। তাই ক্ষমতায় এসে বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস সরকার কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি বা এপিএমসি আইনে বদল করেছিলেন। যে কোনও ব্যবসায়ী যে কোনও বাজারে গিয়ে ফসল কিনতে পারবেন। নাম-ঠিকানা লেখানো, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স জানানোর দরকার নেই। সরকারের দাবি ছিল, এতে চাষিরা ভাল ফল পাবেন। ফল হয়েছে উল্টো। ভিন রাজ্যের অচেনা ব্যবসায়ীরা এসে চাষিদের ঠকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।
দিন্দোরির সুখদেও যাদব পেঁয়াজ বেচেছিলেন উত্তরপ্রদেশের এক ব্যবসায়ীকে। ১ লক্ষ টাকা নগদ মিলেছিল। বাকি ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার চেক বাউন্স করে। ততদিনে ব্যবসায়ী পগার পার। সুখদেওর বুড়ো বাপ মাধো থানায়, পঞ্চায়েতে ঘুরে বেড়াতেন। গত বছর জুলাইয়ে বাড়ির পিছনের উঠোনেই মাধোর দেহ মেলে। গলায় কীটনাশক ঢেলেছিলেন তিনি।
সুখদেওর জন্য এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে সরকার। ৩০ হাজার টাকা মিলেছে। বাকি ৭০ হাজার ডাকঘরে জমা পড়লেও তোলা যাবে না। শুধু মাসে ৪২৮ টাকা সুদ মিলবে। তেমনই নিয়ম।
সুখদেও এখন সেই ১ লক্ষ ৩০ হাজারের বাউন্স হওয়া চেক ভাঁজ করে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। ভাঁজ ছিঁড়ে হয়েছে চার টুকরো। প্রতারণা রুখতে মহারাষ্ট্র সরকার আইনে আবার বদলের কথা ভাবছে বটে। কিন্তু সুখদেওর পকেটে ছেঁড়া চেকে ‘সুখদেও মাধো যাদব’ লেখাটা মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy