Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

কোঙ্কন উপকূলে সাগরের তটে

নিরন্তর মধুর কাতরতায় মোড়া নিবিড় নির্লিপ্ত সাগরবেলা। যেখানে সাবিত্রী নদীর অনায়াস চলন ও আরব সাগরের ঘন নীল গহনে স্বেচ্ছা- সমর্পণ। প্রাণখোলা জলছবি নিয়ে কোঙ্কণ উপকূলের সংসারে ভোরের কথার মতো দিগন্ত ছুঁয়ে শ্রীক্ষেত্র হরিহরেশ্বর। এখনকার দ্বৈত সৈকতের এক পাশে প্রস্তরাকীর্ণ সৈকতে আছড়ে পড়ছে আরব সাগরের দামাল ঢেউ।

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

২৪ মার্চ, ২০১৬
দুপুর ১-৪৫
এমটিডিসি হলিডে হোম হরিহরেশ্বর-৪০২১১০
জেলা: রায়গড়: মহারাষ্ট্র

নিরন্তর মধুর কাতরতায় মোড়া নিবিড় নির্লিপ্ত সাগরবেলা। যেখানে সাবিত্রী নদীর অনায়াস চলন ও আরব সাগরের ঘন নীল গহনে স্বেচ্ছা- সমর্পণ। প্রাণখোলা জলছবি নিয়ে কোঙ্কণ উপকূলের সংসারে ভোরের কথার মতো দিগন্ত ছুঁয়ে শ্রীক্ষেত্র হরিহরেশ্বর। এখনকার দ্বৈত সৈকতের এক পাশে প্রস্তরাকীর্ণ সৈকতে আছড়ে পড়ছে আরব সাগরের দামাল ঢেউ। অন্যটিতে অনাবিল প্রকৃতির সঙ্গে বিপুল সৈকতের অসাধারণ আলাপপর্ব। সাগরের রূপে বিভোর হরিহরেশ্বর গ্রামের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছি নির্জনতার আঁতুড়ঘরে।
বিন্দু বিন্দু কত সফর জেগে থাকে কোঙ্কণ উপকূলের তটে তটে। সেই কোন কাকভোরে ভেলনেশ্বর ছেড়ে বেরিয়েছি অন্য আর এক সৈকত-গন্তব্যে। এ বারের দূরত্ব অনেকটাই। প্রায় ১৮১ কিলোমিটারের মতো। অর্থাৎ প্রায় সওয়া ৪ ঘণ্টার পথ। ভেলনেশ্বর ছেড়ে এক প্রাচীন জনপদ পালমেট। আজ মহারাষ্ট্রে হোলি। কোঙ্কণী গাঁ-গঞ্জে স্থানীয় ভাষায় এই হোলিকে বলা হয় ‘সিগমা’। এই সাতসকালেই পালমেট গ্রামের এক দল পুরুষ অদ্ভুত পোশাক পরে খোল-কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে গৃহস্থের দোরে দোরে মাধুকরী করছেন। গাড়ি থামিয়ে খানিক দূর থেকেই আমি সিগমোৎসবে মাতোয়ারা ওই দলটির একটি ছবি ভরে নিই ক্যামেরায়। আরও খানিক পরেই এল গুহাগর নামের এক মাঝারি জনপদ। গুহাগর সৈকতে যেতে যেতেই পথের দু’পাশে কত যে হিন্দু মন্দির পড়ল। সফরের অছিলায় যাবতীয় অবাধ্য আনন্দে ঢুঁ মারি গুহাগর সৈকতে। নিঝুম সৈকত। গূঢ় নৈঃশব্দ্যে নিসর্গ যেন চুপিসাড়! গুহাগর সৈকতকে বুড়ি ছুঁয়ে ফের চলে যাই। নিজের মতো করে চিনে নিচ্ছি পালমেট, গুহাগড়, স্রুংগারতালি, মোদকাগড়,আঞ্জারলি ফাটা, ভেলদুর, ডাবহল জেটি, আবেদ, কেলসি, বাঙ্কোট, বাগমান্ডালে নামের সব ঘুরঘুট্টি জনপদ। তাদের কোনও কথা নেই, যেন নির্বিকার। এর মধ্যেই দু’বার বার্জ করে সাগরখাঁড়ি পেরোতে হয়েছে। এই যাত্রায় প্রথম ফেরি সার্ভিস ডাবহল থেকে ধোপাভে। এখানেই বশিষ্ঠ নদী সাগর ছুঁয়েছে। এর পরের ফেরি ভেসাভি থেকে বাগমান্ডোলা। দু’বারই জলযানের ওপর বার্জ-এ দু’চাকা চারচাকা-সহ যাত্রী নিয়ে সাগর পারাপার। কত নিত্যনতুন সফর-অভিজ্ঞতা জড়ো হয় ভ্রমণ পাঠক্রমে। আমার সামনে ক্রমশই খুলে খুলে যাচ্ছে পশ্চিমঘাট পাহাড়ের ছোট মাঝারি উত্থান, সাগরের হাতছানি-দেওয়া টান!

ফুরফুরে মৃদু হাওয়ায় রিসর্ট চত্বরের সযত্নলালিত সোনাঝুরি গাছের নরম হিলহিলে ডালগুলো দুলছে। দুপুরের রোদ্দুর গাছের ফাঁক গলে খানিক নিস্তেজ দেখাচ্ছে। সাগরমুখী প্রতিটি কোঙ্কণী কটেজই দারুণ। এ রকম মোট ৮-খানা ‘কোঙ্কণী হাউজ’ ও ১০খানা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক মানের শৌখিন কাঠের কটেজ। বিশাল ঘরের ভিনাইল পর্দা গুটিয়ে নিলেই খোলামেলা জানালা বেয়ে হুমড়ি খেয়ে ঘরে ঢুকবে সমুদ্রের কোলাহল। আধুনিক স্নানাগার ও সংলগ্ন প্রসাধনকক্ষটি চমৎকার। সেখানে বড় আয়না-সহ ড্রেসিং টেবল, আলমারি, তোয়ালে, সাবান সবই বেশ গোছানো। কটেজের এক দিক জুড়ে চওড়া ব্যালকনি। সেখানে কালো রঙের দুটি বেতের চেয়ার পাতা।

চমকপ্রদ এক নিসর্গের পাণ্ডুলিপি থরে থরে জমা হতে থাকে। ব্যালকনির বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেই হল। সীমাহীন নীরবতার পাঠ শিখে, জেগে উঠি। ছায়াটি তখন এ-পাশে ছিল—এখন ও-পাশে। দুপুর গড়াতে থাকে। ব্যালকনির সামনে দিয়েই সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা ধাপে ধাপে নেমে গেছে পাথরঘেরা সাগরজলে। এ কটেজে ঢুকে ব্যাগপত্তর রেখেই এক বার পায়ে পায়ে ঘুরে এসেছি সে পথে। সিঁড়ির ধাপে নোটিস বোর্ডে মরাঠি ভাষায় বিজ্ঞপ্তি লেখা: সাগরে পাথর রয়েছে বলে সাগরস্নানে মানা। বালির ছড়ানো সৈকত নয়, ফলে সমুদ্রস্নানের উপযোগী নয় মোটেই। দূরে বালির চড়া। এখানেই সাবিত্রী নদী ও সাগরের চুম্বন-সহবাস। ডায়েরির পাতায় এই কথাটা লিখতেই মনে পড়ে গেল বহুশ্রুত সেই ইংরেজি প্রবাদ, ‘‘ওয়ান ডে সি আসক্ড রিভার, ‘হাউ লং উইল ইউ কিপ এনটারিং ইনটু মাই সলটি হার্ট?’ রিভার রিপ্লায়েড, ‘আনটিল ইউ বিকাম সুইট’।’’

২৪ মার্চ, ২০১৬

রাত ১০-২০

এমটিডিসি হলিডে
রিসর্ট, হরিহরেশ্বর

বিকেলের ফুরিয়ে আসা পড়ন্ত রোদ কমলা রঙের চাঁদোয়া বিছিয়েছে। ইতিমধ্যে সূর্যের গায়েও লালচে-কমলা রং ধরতে শুরু করে দিয়েছে। হরিহরেশ্বর মন্দিরের কাছে অন্য যে সৈকত রয়েছে সেখানে চলে এসেছি। মোট দুটো সৈকত আছে হরিহরেশ্বরে। উত্তরের সৈকতটি ২.৪ কিলোমিটার চওড়া আর মন্দিরের পাশেই। আর দক্ষিণেরটি ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির ও এরই লাগোয়া জমিতে গড়ে উঠেছে মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের হলিডে রিসর্টটি, যেখানে পাহাড়ের নাগালের মাঝেই অকাতর নীলের জলসাঘর।

চারটি পবিত্র পাহাড় দিয়ে ঘেরা হরিহরেশ্বর গ্রামখানি। হরিহরেশ্বর, ব্রহ্মাদ্রি, পুষ্পাদ্রি ও হরশিনাচল। কোঙ্কণ উপকূলের রায়গড় জেলার এই সৈকতভূমিকে ‘দেবভূমি’ বা ‘শ্রীক্ষেত্র’ও বলা হয়। উত্তরে হরিহরেশ্বর মন্দির। ১৬ শতকে নির্মিত হরিহরেশ্বর মন্দিরে রয়েছেন শ্রীবিষ্ণু, শ্রীব্রহ্মা, শ্রীমহাদেব এবং আদিমাতা যোগেশ্বরী তথা পার্বতী। শ্রীহরিহরেশ্বর নামটি এসেছে হরি-হর-ঈশ্বর থেকে। হরি অর্থাৎ শ্রীবিষ্ণু, হর অর্থাৎ শ্রীমহেশ এবং ঈশ্বর অর্থে শ্রীব্রহ্মা। হরিহরেশ্বর মন্দিরের পশ্চিম দিশায় শ্রীকালভৈরবের স্থান। উত্তর কাশীতে যেমন কালভৈরব রয়েছেন, এখানেও তেমনই। অর্থাৎ প্রথমে শ্রীকালভৈরব দর্শন করাই পরম্পরা। কথিত আছে, শ্রীশঙ্কর একবার শ্রীকালভৈরবকে বর দেন, ‘‘আমাকে দর্শনের পুণ্যলাভ করার অভিপ্রায়ে ভক্তগণ যখন এই মন্দিরে আসবেন, তখন প্রথমেই তোমার দর্শন করবে।’’ এই প্রথা প্রধানত কাশীতে রয়েছে। কালভৈরব-যোগেশ্বরীমাতা দর্শনহেতু দুঃখকষ্ট, অসুস্থতা ও পিশাচদোষ দূর হয় বলেই ভক্তের বিশ্বাস। এখানেও তাই প্রথমে শ্রীকালভৈরব দর্শন, তার পর শ্রীহরিহরেশ্বর দর্শন এবং এর পর আবারও শ্রীকালভৈরব দর্শনের প্রথা এখানে। এ ছাড়া আর একটি প্রথা হল শ্রীকালভৈরবের চরণ দুটি চন্দনচর্চিত করে তবে পূজা করা। পূজারি এখানে চন্দনের প্রলেপ লাগিয়ে মূর্তিকে সুশোভিত করেন।

হরিহরেশ্বর মন্দির নিয়ে আরও পৌরাণিক গাথা আছে। পুরাকালে রাজা দিলীপ বশিষ্ঠ মুনিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘হে মুনিশ্রেষ্ঠ, জগতে এমন কোন স্থান আছে যেখানে যোগসিদ্ধি লাভ হয়, যেখানে সমস্ত দেবতা বাস করেন এবং যেখানে তপস্যা করলে তীর্থদর্শনের ফললাভ হয়?’’ বশিষ্ঠ মুনি বলেন, ‘‘হে রাজা, সব তীর্থের শ্রেষ্ঠ হরিহর তীর্থক্ষেত্র। সেখানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ দুই রূপে অর্থাৎ লিঙ্গ রূপে ও পর্বত রূপে স্থিত আছেন আদিমাতা পার্বতীর সঙ্গে।’’ একই প্রশ্ন গুরু দত্তাত্রেয়ও ভার্গবরামকে করেছিলেন এবং ভার্গবরাম পতিতের পাবনস্বরূপ এই হরিহর তীর্থের কথা বলেছিলেন। আরও অনেক জনশ্রুতি আছে—যেমন অগস্ত্য মুনি তাঁর স্ত্রী লোপামুদ্রার সঙ্গে এই পুণ্য অঞ্চল পরিভ্রমণকালে কালভৈরব শিবমন্দির নির্মাণ করেন। অন্য মতে, পৃথিবী পরিমাপ করার সময়ে শ্রীবিষ্ণু প্রথম পা রাখেন এখানেই। সাগরজলে স্নাত পাথরে রয়েছে সেই ‘বিষ্ণুপদ’। শুক্লতীর্থে ব্রহ্মা পর্বতের সিঁড়ি বেয়ে উপর থেকে প্রতিভাত হয় হরি ও হর পাহাড়ের মাঝে বিশাল পদচিহ্ন। বিষ্ণুপদের দক্ষিণে শুক্লতীর্থে সাগরের জলে একটি কুণ্ড রয়েছে। সৈকতের ধার ঘেঁষে রয়েছে আরও কয়েকটি পবিত্র স্থান—গায়ত্রীতীর্থ, চক্রতীর্থ, সূর্যতীর্থ, গৌতমতীর্থ, নাগতীর্থ, কমণ্ডলুতীর্থ, গৌরীতীর্থ, পাণ্ডবতীর্থ ইত্যাদি। সামান্য দূরে পাথরের চাতালের কাছে একটি কুণ্ড আছে। মহাভারতে উল্লেখ আছে, পাণ্ডব ভ্রাতারা এখানেই পূর্বপুরুষের তর্পণ করেন। হরিহরেশ্বর মন্দিরে কার্তিক উৎসব, শ্রীকালভৈরব জয়ন্তী, মহা শিবরাত্রি, চৈত্রনবমী বা রামনবমী উৎসব খুবই জাঁকজমক প্রথাসিদ্ধ ভাবে পালিত হয়। দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় এই সব উৎসবকালে। শ্রীক্ষেত্র হরিহরেশ্বর মন্দিরের ঐতিহাসিক দিকটির দিকেও নজর করা যাক। ইতিহাসের পাতা জানায়, মরাঠা সাম্রাজ্যে ভট বংশীয় শ্রীমন্ত পেশোয়াদের কুলদেবতা হরিহরেশ্বর। শ্রীমন্ত-পত্নী রমাবাঈ স্বামীর শারীরিক মঙ্গলকামনায় এখানে পুজো দিতে আসেন। ওই সময় তিনি ‘চৌখডা’ নামে এক বাদ্যযন্ত্র পুজোয় বাজানোর প্রথা শুরু করেন। শ্রীমন্ত পেশোয়া এই মন্দিরের প্রবেশদ্বার তৈরি করে দেন। ব্রহ্মা পর্বতের সোপানপথটি নির্মাণ করেন জাওলির সুবেদার চন্দ্ররাও মোরে। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজও নিয়মিত হরিহরেশ্বর মন্দির দর্শনে আসতেন। এই পেশোয়াদের সঙ্গে ১৭৫৬ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসকদের এক যুদ্ধকালীন সন্ধিচুক্তি হয়। ব্রিটিশ সরকার সেই সময় হরিহরেশ্বর এলাকাটি দাবি করে। কিন্তু রামজি পন্থ কিলেদর সাফ বলে দেন, এখানকার হিন্দু জনতা নিজের শির কেটে ফেলবে, তবু হরিহরেশ্বর কখনওই ম্লেচ্ছ ইংরেজদের হাতে তুলে দেবে না। এই বিরোধিতার পর জঞ্জিরা সংস্থান থেকে হরিহরেশ্বর মন্দিরের কার্যভার পালিত হত। যশোবন্ত বালাবন্ত নাগালে—যিনি এক সময় জঞ্জিরার কার্যনির্বাহী পদে ছিলেন, তাঁর সম্পত্তির অনেকখানিই দান করে দেন মন্দির কর্তৃপক্ষকে।

সৈকতে সবাই অপেক্ষা করছে। আমি একাই চলে এলাম মন্দির দর্শনে। মূল প্রবেশদ্বার থেকে কিছুটা হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। সেই পথের দু’পাশেই পূজা-উপচার, মেয়েদের চুড়ি হার দুল-সহ প্রসাধন সামগ্রী, পুজোর সিডি, মন্দিরের রেপ্লিকা, স্থানীয় কোকম শরবত ও আমের নির্যাস, কাজু ইত্যাদির পরপর দোকান। এই সময় একেবারেই ভক্তের ভিড় নেই। ডান দিকের মূল মন্দির চত্বরে গিয়ে প্রণাম করে ফিরে যাই সৈকতে। বেনারস বা কাশীতে এর আগে অন্তত বার পাঁচেক বেড়াতে গেছি একেবারে ছোটবেলা থেকেই। এ বার এখানে ‘দক্ষিণ কাশী’ দর্শনও হয়ে গেল।

ব্যস্ত মহানগরের কোলাজের বাইরে বহু দূরে— হরিহরেশ্বরের এই দিকের সৈকতটির গায়ে এরই মধ্যে এক মুঠো ফাগুন বিছিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং অর্কদেব। সৈকতের গাঢ়রঙা মিহি বালুতট ঝিকমিক করে উঠছে তাতে। হরিহরেশ্বরের উত্তর সৈকতের বালু ঠিক সোনালি নয়, সফেদও নয়। বরং কিছুটা কালো।

সৈকতে ঢেউয়ের দামালপনার সঙ্গে হুটোপুটি খাচ্ছে হরিহরেশ্বরে হোলির ছুটি কাটাতে আসা তামাম পর্যটক। বিনোদনী পশরা নিয়ে হাজির উটওয়ালা, ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি। রঙিন ঝালর দেওয়া উটগুলো যেমন ক্ষয়াটে, তেমনই অপুষ্ট। পর্যটকদের উটের পিঠে বসানোর জন্য উটওয়ালার কাছে মজুত অ্যালুমিনিয়ামের ফোল্ডিং মই। ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি পর্যটক দেখলেই এগিয়ে আসে সওয়ারি পাওয়ার আশায়। কালো মিহি বালিতে ছোট্ট কাঁকড়াদের অনায়াস যাওয়া-আসার চিহ্ন দেখে মনে হয় অপরূপ আলপনা আঁকা। মায়াবী ভিজে ভিজে সেই বালুতটে মানুষের ভ্রমণের সবটুকু চিহ্নই ধরা থাকে। বিকেলের ওপার চিরে সন্ধ্যা নামে হরিহরেশ্বরের বুকে। দূরের আকাশ, পাখির ডাক, সাগর, সৈকত, মন্দির সন্ধ্যার জলসাঘরে থিতু হতে না হতে ফিরে আসি রিসর্টের আরামগৃহে। এমটিডিসি-র রেস্তোরাঁ ভবনটি নতুন করে তৈরি হচ্ছে। সে জন্য সাময়িক একটা ছাউনি দেওয়া, প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল পাতা অস্থায়ী ঝুপড়ি বানানো হয়েছে। খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খাওয়ার টেবিলের তলায় বেওয়ারিশ নেড়ি কুকুর আর লোম ওঠা বিড়াল ঘাপটি মেরে শুয়ে বসে আছে খাবারের লোভে। এক পাশে একটা পাইপের নলের সামনে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে গুচ্ছের এঁটো বাসন। সেখানেই দু’বেলা খাওয়াদাওয়া সারতে হল অনন্যোপায় হয়ে। ব্যালকনিতে পা মুড়ে চেয়ারে বসে ডায়েরি লিখে রাখছি। সকালে ভাটার টানে সাগরমাঝে যে বালির চরা দেখেছিলাম, এখন পূর্ণ চাঁদের মায়ায় সেখানে জল থইথই। সাগরজলে শুধু রুপোলি চাঁদের মিশ্রণ।

২৫ মার্চ, ২০১৬

দুপুর ৩-০৫

এমটিডিসি হলিডে
রিসর্ট, হরিহরেশ্বর

সাগর কথা দিয়েছিল—তার ঢেউয়ের আলোড়ন, নোনা বাতাস, খোলামেলা সৈকত গূঢ় আয়ত্তে ভরিয়ে দেবে সমস্ত নিঝুম চাওয়া-পাওয়া—সফরের পৃষ্ঠা উড়ে উড়ে উচ্ছ্বসিত যে কোঙ্কণ উপকূলকে জড়িয়ে নিয়েছি মায়ার কাজলে। ইতিমধ্যেই অসম্ভব সুন্দর এক ভোর-সকাল ছায়া ফেলেছে হরিহরেশ্বরের নিরালা প্রকৃতিতে। দারুণ গোছানো কটেজের ব্যালকনিতে আবার জুত করে বসি। সোনাঝুরি আর ঝাউয়ের ফাঁক গলে সূর্য চমকাচ্ছে। তার চমকে মিশে আছে সোনালি ছটা। হরিহরেশ্বরের মায়াময় ওম অবকাশের আদলে আঙুলে জড়িয়ে রয়েছে। ভোরের নিঝুমতা ছারখার করে দিচ্ছে নানান পাখির সমবেত কিচিরমিচির। নজরে প়ড়ছে আমাদের গ্রামবাংলার নিতান্ত পরিচিত কিছু পাখিও। দুর্গা টুনটুনি, হাড়িচাচা, বুলবুলি, চড়ুই, ঘুঘু, কোকিল, মুনিয়া কত কী! অবাক হই। যে পাখিদের এত কাল জানতাম বাংলার নিজস্ব বলে, তাদেরই এই বিজন দেশে দেখে চমক লাগে। তাবৎ পাখির উল্লাস একে অপরে মিশে যাচ্ছে। কখনও বাইরের প্রকৃতিকে পরখ করতে পায়চারি করতে থাকি এমটিডিসি রিসর্টের চত্বরে। চেনা অচেনা মিশ্র পর্ণমোচী বৃক্ষের আওতায় পুরো অঞ্চলটাই। সেখানে গাঢ় সবুজ, ফিকে সবুজ, হলদেটে সবুজ—বিচিত্র সবুজের সমাহার। সবুজের বর্ণময় গাছেদের ডাল-পাতার ফাঁক গলে সূর্যের কিরণ যেন আলোছায়ার খেলায় মেতেছে। রিসর্টের এ দিকেও বাঁশ টালির চাল-সহ আরও কিছু কাঠের স্বয়ংসম্পূর্ণ কটেজ রয়েছে। কটেজের দরজায় চাবি ঘোরালেই ভেতরে শীতল আশ্বাস ও আধুনিকতার ফিরিস্তি।

প্রাতরাশে পোহা আর ফিল্টার কফি খেয়ে হেঁটেই শান্ত হরিহরেশ্বর গ্রামখানা ঘুরে নিয়েছি। হরিহরেশ্বর ঢোকার আরম্ভেই ইট-পাথরে বাঁধানো মস্ত তোরণদ্বার। এক পশে মহারাষ্ট্র ট্যুরিজমের পথ-নির্দেশিকা: শ্রীবর্ধন চৌপাটি ২১ কিমি, আর্বা চৌপাটি ২৫ কিমি, দিবেআগর চৌপাটি ৩৮ কিমি দূরত্বে। ‘গ্রাম স্বচ্ছতা অভিযান’ সংবলিত বিজ্ঞপ্তিও রয়েছে সেখানে—‘স্বচ্ছ হরিহরেশ্বর, সুন্দর হরিহরেশ্বর’। এই সৈকত-গ্রামটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরম শান্তশ্রীমণ্ডিত। নারকেল সুপুরি আম ক্যাসুরিনা গাছ রয়েছে অনেক। উত্তরের সৈকতে নারকেল বনের পাশ দিয়েই সৈকতে যাওয়ার পথ। গ্রামে স্থানীয় মানুষজন পরিচালিত ক’টি হোম স্টে-র ব্যবস্থা। সেখানে গৃহস্থ মালিক অতি সাধারণ মানের আহারও অত্যন্ত যত্নের সঙ্গেই পর্যটকদের পরিবেশন করেন। বেশির ভাগই সনাতনী কোঙ্কণী থালি। সঙ্গে ফরমায়েশমত টাটকা সামুদ্রিক মাছের পদ রান্না করে দেন। এমটিডিসি-র থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও হরিহরেশ্বরে শুভান বিচ রিসর্ট, হরিহরেশ্বর বিচ রিসর্ট, শ্রীনগেট রিসর্ট (জৈন হোম স্টে), হোটেল ওম শ্রী, নিওয়ারা রিসর্ট, গোকুল পর্যটন নিবাস, শিবশান্তি হলিডে ইন, মৌলি বিচ রিস:ট, হোটেল নন্দনবন, সাঁই হোটেল এমন হরেক মানের আস্তানা রয়েছে। ফিরতি পথে গুরুগীতা শাকাহারী হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে রিসর্টে ফিরলাম। খাবারের মান সাধারণ হলেও এমটিডিসি-র তুলনায় অনেকটাই সস্তা ও সুস্বাদু।

বিকেলে আবার গেলাম চৌপটি। অনেকক্ষণ কাটালাম সৈকতের সঙ্গে। ফেরার পথে ‘অনু’ নামের এক পথচলতি স্টলে কান্দাভাজি ও চা খেয়ে নিলাম। দোকানি মহিলা আমাদের পথের পাশে প্লাস্টিকের টুল পেতে বসিয়ে—বাসন ধুয়ে, ব্যাসন গুলে, পেঁয়াজ-লঙ্কা কেটে, স্টোভ জ্বালিয়ে, তেল গরম করে, তার পর পেঁয়াজি ভাজলেন আর চা বানালেন। আমরা রাস্তার ধারের টুলে বসে আছি। পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে মোটরবাইক নয় চার-চাকা ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেই কুড়ি-পঁচিশ মিনিট সময়টুকু ওই মহিলার সঙ্গে তাঁর কাজের ফাঁকে ফাঁকে সমানে গল্প করে গেলাম। আসলে কোথাও বেড়াতে গেলেই সচেতন প্রবণতা থাকে, প্রায় গায়ে পড়েই মানুষজনের সঙ্গে আলাপ জমানো। এতে কত স্থানীয় ব্যাপার যে কত সহজেই জানা হয়ে যায়! বেশ মিশএও যাই কখনও কখনও। ডায়েরির পাতায় ভরে রাখি তাঁদের অতি সাধারণ কথাও।

তখনও শেষ বিকেলের আলো রৌণক ছড়াচ্ছে। রিসর্ট লাগোয়া পাথুরে সৈকতে গিয়ে বসি। কালো পাথরে পাথরে ছাওয়া এই সৈকতটা একদমই অন্য রকম। চটি জোড়া দূরে খুলে রেখে, পাথর টপকে টপকে আরও কিছুটা গভীরে গেলাম।পাথরে পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ছিটকে উঠছে সফেদ জলোচ্ছ্বাস। সমুদ্র তোলপাড়। ভিজিয়ে দিচ্ছে অবসরের ঢেউ এসে আপাদমস্তক।

হেসে উঠি আনন্দে বুঁদ হয়ে। মন বলে, ‘এই বেশ ভাল আছি!’

অন্য বিষয়গুলি:

Konkan Mumbai Raigarh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy