জমা পড়ল না স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসম্ভার। জোর করে জাতীয় সড়ক অবরোধমুক্ত করার চেষ্টায় হিতে বিপরীত হল। বাজেটে যৎসামান্য বরাদ্দ হল মণিপুরের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী বেছে নেওয়ার কাজও এগোল না। কুকি-মেইতেইদের নিয়ে শান্তি আলোচনা এখনও বিশ বাঁও জলে। চুম্বকে এই হল রাষ্ট্রপতি শাসনাধীনে মণিপুরের এক মাসের কড়চা।
গত মাসের ৯ তারিখ, বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের আগের রাতে বাধ্য হয়ে ইস্তফা দেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ। বিধানসভা জিইয়ে রেখে, ১৩ জানুয়ারি রাজ্যে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। মণিপুরে এই নিয়ে ১১ বার, যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক!
প্রথমে বলা হচ্ছিল, বিজেপির বিবদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যে রফা করিয়ে শীঘ্রই পরের মুখ্যমন্ত্রী বেছে নেবে হাইকমান্ড। শেষ হবে রাষ্ট্রপতি শাসন। কিন্তু রাজ্য নেতৃত্বের আবেদন বা হুমকিতে সাড়া মেলেনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে। বরং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়, যাঁকেই বেছে নেওয়া হোক, মেইতেই মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে রাজ্যে শান্তি ফেরানো অসম্ভব। তাই রাজ্যে শান্তি ফেরাতে আপাতত সেনা-সহ কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর হাতেই আইন-শৃঙ্খলার ভার ছাড়া হবে। সেনা সূত্রে বলা হয়, কুকি ও মেইতেই, উভয় পক্ষেরই সশস্ত্র সমাজকে নিরস্ত্র করতে তিন মাস সময় পাবে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
কিন্তু কী অর্জিত হল এই এক মাসে?
রাজ্যপাল অজয়কুমার ভল্লা দুই দফায় সময় বেঁধে সব লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র জমা দিতে বলেন। ইতিবাচক দিক বলতে মেইতেই সশস্ত্র বাহিনী আরাম্বাই টেঙ্গল এই প্রথম অস্ত্র জমা দিতে সম্মত হল। রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনার পরে শর্তসাপেক্ষে প্রচুর অস্ত্র জমা দিল তারা। এ ছাড়াও প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার হল সমতল ও পাহাড়ে। কিন্তু সেনা সূত্রে খবর, জমা দেওয়া অস্ত্রের মধ্যে সরকারি অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া ও বিদেশি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ২০ শতাংশও জমা পড়েনি। তাই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এখনও দুই পক্ষের হাতেই পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কুকি এলাকা দিয়ে অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন নিরাপত্তা বাহিনীকে। সেই মতো, জোর করেই রাজ্য পরিবহণ নিগমের বাস চালানো হয় কুকি এলাকার উদ্দেশে। বাসে এক জনও যাত্রী হয়নি। কুকিরা জানিয়ে দিয়েছিল, তাদের দাবি পূরণ না করে জোর করে বাস চালালে ফল খারাপ হবে। সেটাই হয়। বাস চালানো ও তার পথ আটকানো নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় বাস কাংপোকপি ঢোকার আগেই। প্রাণ যায় ১ কুকি যুবকের। নিরাপত্তা বাহিনী, মহিলা ও গ্রামবাসী মিলিয়ে জখম হন অর্ধশতাধিক। আলোচনার বদলে জোর করে শান্তি ফেরানো যে অসম্ভব, তা জানার পরেও কেন্দ্রের এমন পদক্ষেপের জেরে গত নভেম্বর থেকে আপাত শান্ত রাজ্য ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কুকি এলাকায় চলছে অনির্দিষ্টকালের কার্ফু।
তৃতীয়ত, রাজ্যে শান্তি ফেরানোর প্রধান শর্তই যেখানে মেইতেই ও কুকিদের আলোচনার টেবিলে আনা, সেখানে কেন্দ্রের তরফে সেই চেষ্টাই তেমন হল না। সংঘর্ষে নিরপেক্ষ নাগা ও মেইতেই মুসলিম বা পাঙ্গালরা যৌথ ভাবে শান্তির উদ্যোগের প্রস্তাব রেখেছিল। তারা মেইতেই ও কুকিদের সঙ্গে আলোচনাও চালায়। নাগা-কুকি সংঘর্ষের সময়ে নাগাল্যান্ডের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিওর নেতৃত্বে এমনই শান্তি মিশন কাজে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু মণিপুরে তেমন কৌশল ব্যবহারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সাড়া দৃশ্যত মেলেনি।
রাজ্যের বাজেট সংসদে পেশ করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ৩৫,১০৪ কোটি টাকার বাজেটে সংঘর্ষে ঘরছাড়াদের অস্থায়ী আবাস তৈরির জন্য মাত্র ১৫ কোটি টাকা ও বাস্তুহারাদের ঘর গড়তে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ত্রাণকার্যে বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। ক্ষতিপূরণ বাবদ রাখা হয়েছে মাত্র ৭ কোটি। বিরোধীদের দাবি, সংঘর্ষে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ ঘরছাড়া। তাঁদের বেশির ভাগের বাড়িই গুঁড়িয়ে গিয়েছে বা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। কিন্তু বাজেটে ঘোষিত পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের বরাদ্দ সেই তুলনায় নেহাতই নগণ্য।
ফলে, রাষ্ট্রপতি শাসনের তিরিশ দিনে মণিপুর তেমন কোনও আশাজাগানো বদল দেখল না। বরং কেন্দ্রীয় নীতির ব্যর্থতাকে সাক্ষী রেখেই ফের উত্তেজনা ফিরল পাহাড় ও সমতলের মধ্যে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)