মুদার পাথেরিয়া, জয়ন্ত বসু, মেধা পাটকর, কুণাল সরকার, মহেশ রঙ্গরাজন, বিবেক কুমার এবং সুভাষ দত্ত। শুক্রবার বেঙ্গল ক্লাবে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
উন্নয়ন জরুরি, কিন্তু প্রকৃতি ধ্বংস করে নয়!
১৯৮৫ সাল, আজ থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগে নর্মদা নদীর বুকে সর্দার সরোবর বাঁধ তৈরির বিরোধিতা করে মেধা পাটকরের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন। সেই প্রথম জোরদার ভাবে শোনা গিয়েছিল ওই শব্দগুচ্ছ। আজও প্রায় সমান প্রাসঙ্গিক। আজও প্রশ্ন, পরিবেশ রক্ষা কি সত্যিই জরুরি! কারণ, উন্নয়ন ও দূষণ প্রায় হাতে হাত ধরে চলা দু’টি বিষয়। এই নিয়েই শুক্রবার ‘দ্য বেঙ্গল ক্লাব’ ও ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর যৌথ উদ্যোগে একটি আলোচনা চক্রের আয়োজন হয়েছিল শহরে। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সমাজকর্মী মেধা পাটকর, পরিবেশ কর্মী মুদার পাথেরিয়া, গবেষক-লেখক তথা পরিবেশ সংক্রান্ত দীর্ঘ কাজ করে আসা ইতিহাসবিদ মহেশ রঙ্গরাজন, পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্ত, রাজ্য সরকারের পরিবেশ দফতরের সচিব বিবেক কুমার এবং সাংবাদিক জয়ন্ত বসু। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ কুণাল সরকার।
আলোচনার গোড়াতেই জানানো হয়, অনুষ্ঠানের নাম ‘প্রিজ়ারভিং আওয়ার এনভায়রনমেন্ট ইজ় অ্যান এক্সোটিক বাট নট অ্যান এসেনশিয়াল এক্সারসাইজ়’-র মতো তির্যক রাখা হলেও, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই— পরিবেশ রক্ষা অবশ্যই জরুরি। নাম রাখার সার্থকতা এখানেই যে, পরিবেশকে বাঁচানোর গুরুত্ব জেনেও সাধারণ মানুষ বিশ্বজোড়া দূষণের অনেকটা ভাগীদার। তা ছাড়া, উন্নয়নের পিছনে ছুটছে গোটা পৃথিবী। এ দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। যোগাযোগ বাড়াতে পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে রাস্তা। গভীর জঙ্গল ফুঁড়ে এগিয়ে চলেছে রেললাইন। বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে, কিন্তু তা হয়তো আসছে নদীর গতিপথ রুখে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে। সাংবাদিক জয়ন্ত বসু জানান তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। খবরের খোঁজে বেরিয়ে এক সময় শুনেছিলেন, নদীর বুকে বাঁধ তৈরির পরে মানুষের আকুতি, ‘‘নদী ফেরত দাও।’’ নদী-নির্ভর গ্রামের মানুষগুলোর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, বাঁধ ছাড়াও তাঁদের চলে যাবে, কিন্তু নদী ছাড়া বাঁচা অসম্ভব।
কিন্তু সত্যিই কি বাঁধ তৈরি এতটাই অপ্রয়োজনীয়! ইতিহাসবিদ রঙ্গরাজন বলেন, ‘‘ধ্বংস ছাড়া কী করে আমরা কোনও কিছু তৈরি করব!’’ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হলে, পাহাড় কেটে রাস্তা তো তৈরি করতে হবেই।
এ প্রসঙ্গে মেধা পাটকর শুনিয়েছেন তাঁর দীর্ঘ লড়াইয়ের উপাখ্যান। পিএইচ ডি ছেড়ে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে নেমেছিলেন মেধা। নর্মদার উপরে সর্দার সরোবর বাঁধ তৈরি করতে গিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করেছিল সরকার। মেধার দাবি, এত বছর পরে আদালতের রায়ে সকলকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে বলা হলেও, হাজার খানেক মানুষ ঠিকানাহীন। এ ছাড়া ওই অঞ্চলের পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি তো হিসেবেই ধরা হয়নি! প্রবীণ সমাজকর্মীর কথায়, ‘‘এখন কী অবস্থা যদি জানতে চান— নদী শুকোচ্ছে, নদী মরছে। ...বাঁধ বন গ্যায়া, পর নদী খো গ্যায়া।’’
পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্তের অবশ্য আক্ষেপ, ‘‘আমরা শুধু কথাই বলে যাই, কাজের কাজ কিছু করি না! সকলেই এনভায়রনমেন্টাল হিপোক্রিট!’’ প্রায় এই প্রসঙ্গ ধরেই মুদার পাথেরিয়াও জানান, পরিবেশ রক্ষার কথা বলেন সকলে, কিন্তু আর্থিক সামর্থ থাকলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঠান্ডা ঘরেই ঘুমোন, দূষণ জেনেও বিমানে যাতায়াত করেন।
মেধার দাওয়াই, উন্নয়ন বজায় রেখে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে আরও জোর দিতে হবে সকলকে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তামিলনাড়ু এ বিষয়ে অনেকটা এগিয়ে। তারা প্রায় ৫০ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে।’’ নর্মদা আন্দোলনের কথা টেনে তাঁর পরামর্শ, কোনও প্রকল্প শুরুর আগে, এলাকার বাসিন্দাদের কথা শোনা উচিত। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘‘ডেউচা পাঁচামির কয়লা খনির বিষয়টি যে উনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সিদ্ধান্তের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁর জন্য ধন্যবাদ।’’ মেধার আরও বক্তব্য, সহজ, সরল জীবনযাপনেই পরিবেশ রক্ষার পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। পাথেরিয়াও বলেন, ‘‘গোটা বিশ্বের হাতে সমস্যার দায়ভার না ছেড়ে, কার্বন নিঃসরণ কমানো তথা পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে প্রত্যেককে। প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে ঠান্ডা ঘরে থাকার অভ্যাস, সবেতেই রাশ টানতে হবে।’’ রাজ্য সরকারের পরিবেশ দফতরের সচিব বিবেক কুমারের আশা, সকলে একসঙ্গে চেষ্টা করলে অবশ্যই সমাধান মিলবে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy