আদালত চত্বরে নির্ভয়ার মা। সোমবার। ছবি: পিটিআই।
শেষ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন। তার জেরে নির্ভয়া মামলায় অপরাধীদের ফাঁসি ফের পিছিয়ে গেল। এই নিয়ে পরপর তিন বার মৃত্যু পরোয়ানা জারি হওয়ার পরেও ফাঁসি পিছোল।
মঙ্গলবার ফাঁসি হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা নিয়ে সোমবার টানটান উত্তেজনার সাক্ষী ছিল সুপ্রিম কোর্ট ও দিল্লির পাটিয়ালা হাউস কোর্ট। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলাতে থাকে ছবি। দিনের শেষে দিল্লির পাটিয়ালা হাউস কোর্ট ফাঁসি স্থগিত রেখেছে। কারণ, পবন গুপ্তের প্রাণভিক্ষার আবেদন এখন রাষ্ট্রপতির টেবিলে। অতিরিক্ত দায়রা বিচারক ধর্মেন্দ্র রানা বলেন, ‘‘সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সময় অপরাধীর বুকে এমন ক্ষোভ থাকা উচিত নয় যে, দেশের আদালত তাকে সব রকম আইনি সুরাহার সুযোগ দেয়নি।’’
নির্ভয়ার পরিবার আপত্তি তুলে বলেছিল, আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়েই শেষ বেলায় প্রাণভিক্ষার আবেদন জানাচ্ছে অপরাধীরা। কিন্তু বিচারক বলেন, ‘‘আমার মতে, প্রাণভিক্ষার আর্জির সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর করা যায় না। ৩ মার্চ সকাল ৬টায় নির্ধারিত মৃত্যু পরোয়ানা চার জনের জন্যই পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হল।’’ এই রায়ের পরে নির্ভয়ার মা আশাদেবী ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, ‘‘আমি সাত বছর ধরে লড়াই করছি। কিন্তু সরকার,
সুপ্রিম কোর্ট, পাটিয়ালা কোর্ট
তামাশা দেখছে।’’
মঙ্গলবার ভোর ছ’টায় তিহাড় জেলে নির্ভয়া মামলার চার অপরাধী— মুকেশ সিংহ, অক্ষয় ঠাকুর, পবন গুপ্ত ও বিনয় শর্মার— ফাঁসির পরোয়ানা জারি করেছিল পাটিয়ালা হাউস কোর্ট। কিন্তু রায় সংশোধনের আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে কিউরেটিভ পিটিশন দায়ের করে অন্যতম অপরাধী পবন গুপ্ত। তার আর্জি ছিল, ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোক। একই সঙ্গে পবন গুপ্ত ও অক্ষয় ঠাকুরের আইনজীবীরা ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে পাটিয়ালা হাউস কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
দিনভর যা হল
• সকালে সুপ্রিম কোর্ট পবন গুপ্তর কিউরেটিভ পিটিশন খারিজ করল
• পবন গুপ্ত, অক্ষয় ঠাকুরদের ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়ার আর্জি খারিজ পাটিয়ালা হাউস কোর্টে
• রাষ্ট্রপতির কাছে পবন গুপ্তর প্রাণভিক্ষার আবেদন জমা পড়ল
• পাটিয়ালা হাউস কোর্ট পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত ফাঁসি পিছিয়ে দিল
সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় পবনের কিউরেটিভ পিটিশন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ। এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি মামলারও শুনানি শুরু হয় সুপ্রিম কোর্টে। প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী, ৮৮ বছরের এস পরমেশ্বর নাম্পুথিরি এই মামলা করেছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তাতে কর্ণপাত করতে রাজি হয়নি। আশ্বস্ত হয়ে নির্ভয়ার বাবা-মা, বদ্রীনাথ
ও আশাদেবী ছোটেন পাটিয়ালা
হাউস কোর্টে।
ফাঁসি পিছিয়ে দেওয়ার দাবির পিছনে অপরাধীদের আইনজীবীরা তিনটি যুক্তি দিয়েছিলেন। এক, অক্ষয় ঠাকুরের প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতি খারিজ করে দিলেও দ্বিতীয় বার প্রাণভিক্ষার আবেদন জমা পড়েছে। দুই, পবনের কিউরেটিভ পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়েছে। তিন, দিল্লি ভোটের আদর্শ আচরণবিধি বলবৎ থাকার মধ্যে বিনয় শর্মার প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জমা পড়েছে।
বিচারক রানা অবশ্য সব যুক্তিই খারিজ করে দেন। অক্ষয়ের আইনজীবী এ পি সিংহকে তিনি প্রশ্ন করেন, কবে দ্বিতীয় প্রাণভিক্ষার আবেদন জমা পড়েছে? তিনি বলেন, ২৯ ফেব্রুয়ারি। বিচারক প্রশ্ন করেন, কবে প্রথমটি খারিজ হওয়ার খবর মিলেছিল? এ পি সিংহ জানান, ৫ ফেব্রুয়ারি। ক্ষুব্ধ বিচারক বলেন, ‘‘আমি জানতে চাই, ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আর্জি খারিজ হওয়ার পরেও দ্বিতীয় আর্জির জন্য ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন কেন? আপনি এটা কী করে করতে পারেন? মক্কেলকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখে তার পর মামলা দায়ের করেন?’’
আদালতে যখন এই শুনানি চলছে, তখন বাইরে ফাঁসি না দেওয়ার আর্জি জানিয়ে ব্যানার হাতে হাজির হয়েছেন মুকেশের বাবা-মা মঙ্গেলাল সিংহ ও কল্যাণী দেবী। ছিলেন পবন গুপ্তর বোন রিঙ্কু এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা। বেলা একটা নাগাদ পাটিয়ালা হাউস কোর্ট ফাঁসি পিছনোর আর্জি খারিজ করে দেয়। খুশিতে ফেটে পড়েন নির্ভয়ার বাবা-মা।
বদ্রীনাথ বলেন, ‘‘এক বছর ধরে কী ভাবে লড়াই করছি, কেউ জানে না। বেসরকারি চাকরি, আদালতের চক্করে রোজ যেতে পারিনি। বেতন কাটা গিয়েছে। এ বার নিশ্চিত, কালই ফাঁসি হচ্ছে।’’ আশাদেবী বলেন, ‘‘ওরা আদালতের অনেক সময় নষ্ট করেছে। আর নয়।’’
কিন্তু এই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই এ পি সিংহ আদালতে গিয়ে জানান, পবনের তরফে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জমা পড়েছে। তা খারিজ হলেও ফাঁসির আগে ১৪ দিন সময় দিতে হবে। অতএব ফাঁসি স্থগিত রাখা হোক। ফের ফাঁসি পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আশাদেবী বলেন, ‘‘যখন সকালে কোর্ট প্রশ্ন করেছিল, কোনও প্রাণভিক্ষার আবেদন বকেয়া রয়েছে কি না, তখন এরা কিছু বলেনি।
এখন বলছে, প্রাণভিক্ষার আবেদন জমা পড়েছে।’’
এ পি সিংহ উত্তরে জানান, সুপ্রিম কোর্টে কিউরেটিভ পিটিশন খারিজ হওয়ার পরে বেলা ১১টায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জমা পড়েছে।
দুপুরের পরে ফের শুনানি শুরু হলে বিচারক রানাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এ পি সিংহকে তিনি বলেন, ‘‘আপনি আগুন নিয়ে খেলা করছেন। আপনার সতর্ক হওয়া উচিত। কেউ যদি একটাও ভুল পদক্ষেপ করেন, তার ফলাফল আপনারা জানেন।’’
এর আগে ৭ জানুয়ারি মৃত্যু পরোয়ানা জারি হলেও তা ১৭ জানুয়ারি ও ৩১ জানুয়ারি, দু’বার পিছিয়ে যায়। প্রথম বার ফাঁসির দিন ঠিক হয়েছিল ১১ জানুয়ারি। পরে তা পিছিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি হয়। কিন্তু ৩১ জানুয়ারি তা ফের পিছিয়ে দেওয়া হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy