Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

খরচ কমাতেই টাকার বোঝা নামাচ্ছে রেল

মনে হতেই পারে প্রহেলিকা! ভাঁড়ার ঠনঠনে। তবু টাকার বোঝা আর টানতে রাজি নয় রেল। কেননা রোজকার অর্থের দায় সামলাতে না-হলেই নাকি তাদের লাভ! ওই বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই নাকি খরচ কমে!!

টাকা বহনের সিন্দুক এবং (ডান দিকে)টাকা ভরার বটুয়া। — নিজস্ব চিত্র

টাকা বহনের সিন্দুক এবং (ডান দিকে)টাকা ভরার বটুয়া। — নিজস্ব চিত্র

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৯
Share: Save:

মনে হতেই পারে প্রহেলিকা!

ভাঁড়ার ঠনঠনে। তবু টাকার বোঝা আর টানতে রাজি নয় রেল। কেননা রোজকার অর্থের দায় সামলাতে না-হলেই নাকি তাদের লাভ! ওই বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই নাকি খরচ কমে!!

রেলের এ-হেন অভিপ্রায়ে ধন্দ লাগতেই পারে। কেননা আয় বাড়ানোর জন্য হরেক কিসিমের পন্থা অবলম্বন করতে দেখা গিয়েছে তাদের। তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। এখন তাদের এই অর্থ-বৈরাগ্য কেন?

আসলে ‘টাকার বোঝা’ বলতে রোজকার টিকিট বিক্রির টাকার দায়দায়িত্ব বোঝানো হচ্ছে। সেই ভার নামাতেই বাতিল করা হচ্ছে বিভিন্ন শাখার সব স্টেশনের টিকিট বিক্রির টাকা ডিভিশনের সদরে নিয়ে আসার পদ্ধতি। রেলের এই সিদ্ধান্তে বিভিন্ন শাখার নিত্যযাত্রীদের চিরপরিচিত নিত্যদিনের ‘ক্যাশ ট্রেন’ পাল্টে যাচ্ছে একেবারে সাধারণ খড়্গপুর, নৈহাটি, কৃষ্ণনগর বা বনগাঁ লোকালে।

‘ক্যাশ ট্রেন’ ব্যবস্থা চলে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া-খড়্গপুর শাখার কথাই ধরা যাক। রেলের খবর, ওই শাখায় এক দিনে টিকিট বিক্রি বাবদ এক কোটিরও বেশি টাকা জমা পড়ে। মোট ৩৪টি স্টেশনে সারা দিনে যত টিকিট বিক্রি হয়, সেই টাকা পরের দিন সকালে নির্দিষ্ট সময়ে একটি লোকাল ট্রেনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় খড়্গপুরে। ডিভিশনের সদর দফতরে তা গুনে জমা রাখা হয় ক্যাশ অফিসে। সপ্তাহে তিন বার ওই টাকা পাঠানো হয় নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে। রেল সূত্রের খবর, ওই টাকা বহনের জন্য লোকাল ট্রেনের পিছনের ভেন্ডারে দু’-একটি সিন্দুক থাকে। থাকে সশস্ত্র রেলরক্ষীদের প্রহরা। থাকেন রেলের অ্যাকাউন্টস দফতরের কর্মীরাও। বিভিন্ন স্টেশনে অন্যান্য লোকাল ট্রেনের যত ক্ষণ দাঁড়ানোর কথা, এই ট্রেনটি থামে তার চেয়ে একটু বেশি সময়। ট্রেন ঢুকলেই স্টেশনের টিকিট ঘর থেকে টাকা-ভর্তি চামড়ার ব্যাগ-বটুয়া নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে যান বাণিজ্যিক বিভাগের কর্মীরা। ট্রেন থামলে সেই টাকার ব্যাগ-বটুয়া তুলে দেওয়া হয় ট্রেনের ভেন্ডার কামরায় থাকা ক্যাশিয়ারের হাতে। তিনি ওই বটুয়া ঢুকিয়ে দেন সিন্দুকে।

দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা এই ছবিটাই বদলে যাচ্ছে নতুন সিদ্ধান্তে। রেল ঠিক করেছে, আর এ ভাবে প্রতিদিনের টিকিট বিক্রির টাকা বহন করা হবে না। কেন এই পরিবর্তন?

এক কথায় রেলকর্তাদের জবাব, খরচ কমাতেই টাকার বোঝা নামানোর এই সিদ্ধান্ত। তাঁরা জানান, আয় বাড়াতে খরচ কমানো এবং ঠিক সময়ে ট্রেন চালানোর উপরেই এখন জোর দিচ্ছে রেল বোর্ড। তার সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি তো রয়েছেই। আর এই কারণেই টাকা বহনের ওই পদ্ধতি তুলে দিচ্ছে রেল। প্রতিদিনই যাত্রী-সংখ্যা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে টিকিটও বিক্রিও। বাড়ছে টাকার অঙ্ক। ফলে আগে যেখানে একটি সিন্দুক রাখা হতো, এখন সেখানে দু’টি বা তিনটি সিন্দুক বহন করতে হচ্ছে। বাড়ছে চামড়ার ব্যাগ-বটুয়ার চাহিদাও। টাকার অঙ্ক বাড়ায় তা গোনার জন্য কর্মী-সংখ্যাও বাড়াতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ওভারটাইমের পরিমাণ। তাতে অহেতুক বিস্তর টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। কলুর বলদের মতো তাই টিকিটের টাকার ওই বোঝা আর টানতে চাইছেন না রেল-কর্তৃপক্ষ।

ক্যাশ ট্রেনের সঙ্গে ট্রেন লেটের ব্যাপারটাও জড়িয়ে আছে। রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, ক্যাশ ট্রেন একটু বেশি সময় ধরে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকায় তার পিছনে থাকা সব ট্রেনেরই দেরি হয়ে যায়। এই নিয়ে অসন্তোষ আছে যাত্রীদেরও। সাধারণ ট্রেনের দেরি কমানোটাও ক্যাশ ট্রেন তুলে দেওয়ার একটা কারণ।

এখন তা হলে কী ভাবে টিকিট বিক্রির টাকা বহন করা হবে?

টাকা বইবে ব্যাঙ্ক। এত দিন রেলকে নিজেদের দায়িত্বে ওই টাকা গুনে ব্যাঙ্কে পৌঁছে দিতে হতো। নতুন ব্যবস্থায় ব্যাঙ্কই যাবে স্টেশনে স্টেশনে। তারা নিজেদের রক্ষী নিয়ে টিকিট বিক্রির টাকা সংগ্রহ করবে। গুনবে। নিয়ে যাবে নিজেদের ঘরে।

টাকা গোনার দায়িত্ব, তার জন্য ওভারটাইমের বাড়তি খরচ, সুরক্ষার দায়— কিছুই আর বহন করতে হবে না রেলকে। এই ব্যাপারে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সঙ্গে মউ বা সমঝোতাপত্র সই করেছে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেল। সম্প্রতি এই রকমই একটি মউ সাক্ষরিত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব রেল ও স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার মধ্যে। ঠিক হয়েছে, আগামী ১ অক্টোবর থেকে হাওড়া-খড়্গপুরের মধ্যে আপাতত ৮১টি স্টেশনের টাকা তুলে নেবে এসবিআই। বাকি স্টেশনগুলির টাকাও আস্তে আস্তে নিতে শুরু করবে ওই ব্যাঙ্ক। এ রাজ্যে রেলের দুই জোনেই এই পদ্ধতি বদলের কাজ চলছে। মাস পাঁচেক ধরে সারা দেশে সব জোনেই এই পদ্ধতির পরিবর্তন করছে রেল বোর্ড।

এতে ব্যাঙ্কের লাভ কী?

টাকাটা দিনের দিন জমা প়ড়বে ‘কারেন্ট অ্যাকাউন্ট’-এ। রেল সেটা না-তোলা পর্যন্ত মূলধন হিসেবে ওই টাকা ব্যবহার করতে পারবে ব্যাঙ্ক। সেটাই তাদের লাভ।

নতুন বন্দোবস্তে লাভ দেখছে রেলও। কিন্তু মুষড়ে পড়েছে কয়েক হাজার সিন্দুক এবং কয়েক লক্ষ মার্কা মারা চামড়ার বটুয়া-ব্যাগ! শতাধিক বছরের এই পদ্ধতি পাল্টা যাওয়ায় অবসরে যেতে হচ্ছে তাদের। এর পরে তাদের কি কিছুই করার থাকবে না?

ওই সব সিন্দুক ও বটুয়া নিয়ে রেল কী করে, সেটাই এখন দেখার।

ক্যাশ ট্রেন কী

• রেল-কর্তৃপক্ষ কোনও শাখার টিকিট বিক্রির টাকা বহনের জন্য যে-ট্রেনটিকে নির্দিষ্ট করেন, সেটিকেই বলা হয় ক্যাশ ট্রেন। এটি আলাদা কোনও ট্রেন নয়। লোকাল বা প্যাসেঞ্জার যা কিছু হতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

Railway cash train
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy