নাসিরুদ্দিন শাহ ফাইল ছবি
শাসক দলের নেতানেত্রীরা পয়গম্বরকে নিয়ে কুকথা বলার জেরে ভারতের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে। সেই সঙ্গে দেশের ভিতরে বিদ্বেষ-বিষেও নতুন ইন্ধন পড়েছে। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে সক্রিয় হওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ।
একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বুধবার নাসির বলেছেন, ‘‘টুইটারে প্রধানমন্ত্রী এমন অনেক ঘৃণা-প্রচারককে ফলো করেন। আমার মনে হয়, ওঁর কিছু করা উচিত। এই বিষ যাতে আর না বাড়ে তার জন্য ওঁরই সক্রিয় হওয়া উচিত।’’
নূপুর শর্মা-নবীন জিন্দলকে নিয়ে এই বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী অবশ্য নিজে এখনও অবধি কোনও কথা বলেননি। তবে দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বিজেপি সব ধর্মকে সম্মান করে। বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, নূপুরদের কথার সঙ্গে সরকারের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই সব দাবি কতটা আন্তরিক, কতটা যথার্থ তা নিয়ে বিরোধীদের যেমন প্রশ্ন আছে, প্রশ্ন আছে নাগরিক সমাজেও।
বুধবার অনেকটা তাদেরই মুখপাত্র হয়ে নাসির বলেছেন, ‘‘আমি আবেদন করব, প্রধানমন্ত্রী যেন ওই সব লোকেদের (ঘৃণাভাষীদের) খানিক সদ্বুদ্ধি দেন। হরিদ্বারের ধর্ম সংসদে যা বলা হয়েছে, সেটা যদি তাঁরও মত হয়, তিনি সেটাই বলুন। যদি তা নয়, সেটাও বলুন।’’ ধর্ম সংসদ থেকে সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের গণহত্যা সংঘটনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। নাসিরের ইঙ্গিত সেই বক্তব্যের প্রতিই।
বিজেপির পক্ষ থেকে আপাতত নবীনকে বহিষ্কার এবং নূপুরকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দলীয় বিবৃতিতে তাঁদের দলের মূলস্রোতের বাইরের মানুষ (ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট) বলেও দাবি করা হয়েছে। নাসির এ দিন সেই ‘কৌশল’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, নূপুর শর্মা দলের জাতীয় মুখপাত্রদের একজন ছিলেন। তিনি কী ভাবে ‘দলের খুচরো লোক’ হয়ে যান? বস্তুত এই প্রশ্নে বিজেপির ভিতরেও যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি হয়েছে।
নপূর শর্মার সমর্থনে হ্যাশট্যাগ তৈরি করে নেট দুনিয়ায় প্রচারও চলছে। নূপুর নিজে এই বিতর্কের পরে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে বলেছিলেন, শিবের নামে লাগাতার অসম্মানসূচক কথা শুনতে শুনতে তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি কুকথা বলে ফেলেছিলেন। নাসিরের দাবি, হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে সংখ্যালঘুদের তরফে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, এমন ঘটনা তিনি মনে করতে পারছেন না। বরং সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ অভিনেতার মনে হয়েছে, ‘‘নূপুরের দুঃখ প্রকাশ আন্তরিক নয়। বিক্ষত হৃদয়ে প্রলেপ লেপনও তার লক্ষ্য নয়।’’ উল্টো দিকে কুকথা বির্তকের বদলা নেওয়ার ডাক দিয়েছে জঙ্গিরা। নূপুর নিজেও হুমকির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। নাসির সেটাও সমর্থন করছেন না। তাঁর মতে, ‘‘ওই ভাবে ভাবাটাই ভুল। ওই পথে হেঁটেই পাকিস্তান আর আফগানিস্তান বুধবার তাদের বর্তমান দশায় এসে পৌঁছেছে। আমরা নিশ্চয়ই তাদের অনুকরণ করতে চাই না। কিন্তু সেটাই করে বসি। গোহত্যার সন্দেহে লোককে খুন করা হচ্ছে। এ সব তো বর্বরোচিত সংস্কৃতিতে হয়, কট্টর ইসলামি দেশে হয়! ভারত তো তা নয়।’’
তা হলে ভারতের মতো দেশে এত ঘৃণার চাষ হল কী ভাবে? নাসির বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন বৃহত্তর ঐতিহাসিক পটভূমির কথাও। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের বাবা-মায়ের প্রজন্মও এক ভাবে এর জন্য দায়ী। তাঁরা হয়তো সরাসরি এই ভাবে ঘৃণা ছড়াননি। কিন্তু তাঁদের দেশভাগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা দীর্ঘদিন ধরে চালু থেকেছে। অনেক দিন ধরে পুঞ্জীভূত বিষয়গুলো ধীরে ধীরে বৈধতা পেয়ে গিয়েছে।’’
বলিউডের তিন খানের কি বর্তমান বিতর্ক নিয়ে মুখ খোলা দরকার ছিল? নাসিরের জবাব, ‘‘আমি তো ওঁদের জায়গায় নেই। ওঁদের নিশ্চয় ঝুঁকি অনেক বেশি।’’ তিনি মনে করিয়ে দেন, মাদক মামলায় শাহরুখ খানের ছেলেকে জড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ। বলেন, ‘‘শাহরুখ যে ভাবে আত্মমর্যাদার সঙ্গে বিষয়টার মোকাবিলা করেছে, সেটা প্রশংসনীয়। ওর অপরাধ, ও তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করেছিল। সোনু সুদের বাড়িতেও তো তল্লাশি হয়েছে। এখন যে কেউ কিছু বললেই তাকে তার মূল্য দিতে হবে। আমি জানি না, পরের নিশানা হয়তো আমি!’’ জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের কথা স্মরণ করিয়ে নাসির বলেন, ‘‘এ দেশে এখন শান্তি-সংহতির কথা বললে জেলে যেতে হয়!’’
তবে এত কিছুর পরেও তিনি যে নিজেকে কোণঠাসা বলে মনে করেন না, সে কথাও জোরগলায় বলেছেন নাসিরুদ্দিন। গেরুয়া জমানায় অসহিষ্ণুতা আর বিদ্বেষের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে এর আগেও অনেক বারই মুখ খুলেছেন তিনি। এ দিন নিজের সম্পর্কে তাঁর সংযোজন, ‘‘এ দেশের মুসলমানদের সংখ্যাগুরু অংশকে যে ভাবে ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে বা কোণঠাসা হতে হচ্ছে, আমার সৌভাগ্য যে আমি সেই দলে পড়ি না। প্রতিষ্ঠান বিরোধী কথা বলার জন্য কাজের অভাব আমার হয়নি। আমি মুসলিম, আমার স্ত্রী হিন্দু। তার জন্য আমাকে একঘরে হতে হয়নি। এ দেশে আমি অখুশিও নই। আমি আশা করি, শুভ বুদ্ধির জয় হবে। কোনও না কোনও দিন ঘৃণার এই জোয়ার অবসৃত হবে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy