ভিক্টোরিয়ায় শনিবার সেই শো-এর এক মুহূর্ত—পিটিআই
ইস্কাবনের টেক্কাটা একেবারে শেষের জন্যই সম্ভবত তুলে রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শনিবার সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন নিয়ে যে ‘প্রোজেকশন ম্যাপিং’ হল, তা এক কথায় অনবদ্য। অন্তত সেখানে হাজির দর্শকদের প্রাথমিক অভিভূত প্রতিক্রিয়া তেমনই বলছে। ওই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশনকারী শিল্পী ঊষা উত্থুপ যেমন বলছেন, ‘‘আমি জানতে চাই, ওই লাইট অ্যান্ড সাউন্ডটা কার পরিকল্পনা! ওটা কারা করেছেন!এমন জিনিস এর আগে কখনও দেখিনি। আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে পটভূমিকাটা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ওই স্থাপত্যের পটভূমিকায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড একটা অন্য মাত্রা পেয়ে গিয়েছিল!’’
ঊষার প্রশ্নের জবাব খুব সরল এবং সংক্ষিপ্ত— নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।
বাংলার গায়িকাকে জানানো গেল না, ওই পুরো অনুষ্ঠানেরই পরিকল্পনা খোদ প্রধানমন্ত্রীর। এবং ঘটনাচক্রে, মোদী যে এমন একটি উপস্থাপনার পরিকল্পনা করেছেন, তা ৪৮ ঘণ্টা আগে পর্যন্তও জানা ছিল না কেন্দ্রীয় সরকারের তাবড় আমলা এবং মন্ত্রীদের। একটি সূত্রের দাবি, এমনকি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককেও আগে থেকে ওই বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। কারণ, মোদী চেয়েছিলেন ওস্তাদের মারটা শেষ সন্ধ্যায় দিতে। সেটা দিয়েই শহর ছাড়লেন তিনি।
কলকাতা শহরের বাছাই দর্শকদের উপস্থিতিতে দৃশ্যকল্প ও শব্দের মাধ্যমে নেতাজির জীবন ও কাজ আধারিত যে ইতিহাস প্রাণবন্ত করে ফুটিয়ে তোলা হল, তাতে এক দিকে রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। অন্য দিকে রয়েছে বাংলার সংস্কৃতির অবধারিত ছোঁয়া। অথচ, কোথাও যেন পুরোপুরি বাঙালিসুলভ নয়। একুশ শতকীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ২২ মিনিটের এই ‘প্রোজেকশন ম্যাপিং’ দর্শকদের হতবাক করে দিয়েছে।
অন্ধকার ভিক্টোরিয়া চত্বরের আবহে ‘উঠো গো ভারত লক্ষ্মী’ গানের পর সৌধের গায়ে আলোয় ছবি। আবহে ভেসে এল, ‘আমি রেডিয়ো আজাদি। স্থানীয় সময় ২টো। ভারতীয় সময় সন্ধে সাড়ে ৬টা। আমি সেই সময়ের আবিষ্কার, যখন শব্দ তরঙ্গে সওয়ার হওয়া শেখেইনি। কিন্তু বেতার হয়েও আমি সহস্র মানুষের মধ্যে যোগাযোগের তার জুড়ে দিতাম…।’
এর পরই রেডিয়ো বার্তায় ভেসে এল, ‘‘আমি সুভাষ বলছি।’’ আজাদি রেডিয়ো এবং কল্পিত নেতাজির সেই কথোপকথনে এক দিকে যেমন নাটকীয়তা, অন্য দিকে তেমনই গাম্ভীর্য। নেতাজির কণ্ঠে শোনা গেল, ‘‘আজ আমরা এবং আমাদের মাতৃভূমি বিশ্ব ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছি। আজ আমি সব স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি, বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে তত ক্ষণ লড়াই করুন। যত ক্ষণ না মাতৃভূমি স্বাধীন হয় ততক্ষণ লড়াই করুন। জয় হিন্দ!’’
সূত্রধার বললেন, ‘‘১৯৩৯। বিশ্ব ইতিহাসে এমন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনার সাল, যে যুদ্ধ তার অন্তে নতুন পরিভাষা গড়ে দিল। পরাধীন ভারতবাসী স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’’
সৌধের গায়ে তখন বোমারু বিমানের দৃশ্যকল্প। বোমা পড়ার ছবি এবং ধ্বনির মিশেল তৈরি হল যেন যুদ্ধের আবহ। সেই ইতিহাস তখন বলছেন কথক। সুভাষ কংগ্রেস ছাড়ার পর নিজের সংগঠনকে মজবুত করার কাজে তখন ব্যস্ত। তাঁর মত ছিল ভিন্ন— ‘‘স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। অহিংসা খুবই পবিত্র নীতি। কার্যকরীও বটে। কিন্তু যখন তাতে কাজ হয় না, তখন অন্য রাস্তা খুঁজতেই হয়। ভারতের জন্য এ এক সুবর্ণ সুযোগ। ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আর কোনও আপস নয়।’’ ভিক্টোরিয়ার মূল সৌধের স্থাপত্যে তখন সুভাষের মুখ। শোনা যাচ্ছে তাঁর বক্তৃতার পর ঝোড়ো হাততালিও।
কখনও ভিক্টোরিয়ায় দেওয়াল-থাম জুড়ে আলিপুর জেল। কখনও জেলের গরাদের ভিতরে সুভাষের আমরণ অনশন। কখনও অস্থির পায়চারি। এর পর আবার অন্ধকার ভিক্টোরিয়া। কথক বলছেন, ‘‘১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে ভাইপো শিশিরকুমার বসুর সহায়তায় গলাবন্ধ শেরওয়ানি, ঢোলা পাজামা এবং টুপি পরে মহম্মদ জিয়াউদ্দিনরূপী সুভাষ দেশের বাইরে চলে গেলেন।’’ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ফুটে উঠল সে দিনের বেশে সুভাষের ছবি এবং গাড়ি করে গোমো স্টেশন যাওয়ার ঘটনা পরম্পরা। এর পর তাঁর বিভিন্ন ছদ্মবেশে বার্লিন যাওয়ার ছবি। সুভাষের দেশ ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ও আমার দেশের মাটি…’।
কখনও ফ্ল্যাশব্যাকে সুভাষের জীবনকাহিনি, সঙ্গে কখনও বালগঙ্গাধর তিলক, কখনও ঋষি অরবিন্দ। আইসিএস পরীক্ষার জন্য বাবা জানকীনাথের আদেশে বিদেশ যাওয়ার মুহূর্তে গোটা ভিক্টোরিয়া যেন সুভাষের যাওয়ার জাহাজ। তার ডেক-সহ পুরো অবয়বই পরিষ্কার। এর পর তাঁর দেশে ফেরা, কংগ্রেসে যোগদান, বার বার জেলে যাওয়া এবং ভারতীয়দের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিচয় ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁর জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ইতিহাস, গাঁধীজির সঙ্গে মতপার্থক্য শেষে কংগ্রেস ত্যাগ এবং শেষে আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান— দর্শকদের বিহ্বল করে সব ফুটে উঠল ধ্বনি-ছবি-সুরে। প্রত্যাশিত ভাবেই ওই শোয়ে দেখা যায়নি নেতাজির মৃত্যুর প্রসঙ্গ।
শেষে ভিক্টোরিয়া রঙিন ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’। অনুষ্ঠানের শেষে বাড়ি ফেরার পথে এক আমন্ত্রিত অভ্যাগত বলছিলেন, ‘‘শনিবারের সন্ধ্যার সেরা অংশ। ভিক্টোরিয়ার গম্বুজে নেতাজির ছবি দেখে সকলে খুব আবেগতাড়িত আর উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিলেন। ওই মুহুর্তটাই সেরার সেরা!’’
ঠিকই। শেষ ওভারে হেলিকপ্টার শটই বটে!
(এই প্রতিবেদনের একটি শব্দ নিয়ে পাঠকদের কেউ কেউ আপত্তি তুলেছেন। কিন্তু কাউকে আঘাত করার জন্য এই শব্দ আনন্দবাজার ডিজিটাল ব্যবহার করেনি। তা সত্ত্বেও কারও ভাবাবেগ আহত হয়ে থাকলে আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমরা সেই শব্দটি বদলে দিলাম)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy