Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

চাপের মুখেও জেটলিকে সরাচ্ছেন না মোদী

সুব্রহ্মণ্যম স্বামী এবং আরএসএসের একাংশ অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অরুণ জেটলিকে সরাতে মরিয়া হলেও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সরাচ্ছেন না। গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ বৈঠকের পর জুলাই মাসের গোড়ায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদলের সম্ভাবনা আরও বেড়ে গিয়েছে।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ২১:১০
Share: Save:

সুব্রহ্মণ্যম স্বামী এবং আরএসএসের একাংশ অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অরুণ জেটলিকে সরাতে মরিয়া হলেও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সরাচ্ছেন না।

গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ বৈঠকের পর জুলাই মাসের গোড়ায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদলের সম্ভাবনা আরও বেড়ে গিয়েছে। আজ মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও সঙ্গেও মন্ত্রক ধরে ধরে কাজের অগ্রগতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন প্রধানমন্ত্রী। ক্যাবিনেট সচিব ও প্রধান সচিবের সহায়তার মন্ত্রীদের রিপোর্ট কার্ড বানানোর প্রস্তুতিও শুরু করেছেন মোদী। এই সম্ভাব্য রদবদলের আগে অর্থমন্ত্রক থেকে অরুণ জেটলিকে সরানোর ব্যাপারে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী যতই চেষ্টা করুন না কেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে না সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

জেটলিকে সরানোর ব্যাপারে একটি কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী অনেকদিন ধরেই আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে। তার মস্ত বড় কারণ হল, অরুণ নিজে সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছেন অর্থমন্ত্রকে। অতীতে টু-জি থেকে ভোডাফোন— নানা বিষয়ে দেখা যেত অর্থমন্ত্রকে কী ভাবে কায়েমি গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল। জেটলি আসার পর সেই সব বন্ধ হয়েছে। তার উপর দলের তহবিল সংগ্রহের সঙ্গেও যাঁরা জড়িত, তাঁদের একটি অংশও অরুণকে নিয়ে সন্তুষ্ট নন। ইন্দিরা গাঁধীর সময় থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষ ভাবে অর্থমন্ত্রীর একটি দায়িত্ব ছিল তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে। কারণ, সব শিল্পগোষ্ঠীই অর্থমন্ত্রীর সাহায্যপ্রার্থী থাকতেন। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলেই অরুণ জেটলি জানিয়েছেন, অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি কাউকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার জন্যও কোনও ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেননি।

অরুণের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, এমনকী অর্থমন্ত্রী তাঁর অধীনে থাকা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর (ইডি) কাজেও কোনও ভাবে নাক গলান না। কাউকে বিপাকে ফেলা কিংবা কাউকে আড়াল করার ব্যাপারেও কোনও বাড়তি পদক্ষেপ করেন না। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই অর্থমন্ত্রীর কাজে অনেকেই সন্তুষ্ট হবেন না। এই পরিস্থিতিতে অরুণ জেটলিকে সরাতে পারেন মাত্র দু’জন ব্যক্তি। এক, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দুই, সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সরাতে চাইছেন না। তার একটি কারণ হল, জেটলির কোনও বিকল্প নেই। অর্থমন্ত্রীর পদটি সবসময় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়। অতীতে অন্য প্রধানমন্ত্রীরাও ভেবেচিন্তে এই পদে নিয়োগ করতেন।

অতীতে নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই সময় প্রণব মুখোপাধ্যায় নিশ্চিত ছিলেন, তিনি অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন। এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে জয়রাম রমেশের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, জয়রাম তাঁর সঙ্গে নর্থ ব্লকে থাকতে চান না কি সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু প্রণবকে না বেছে নরসিংহ রাও আই জি পটেলকে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি রাজি হননি। তারপর মনমোহন সিংহকে অনুরোধ করায় তিনি রাজি হয়ে যান। হর্ষদ মেটার কেলেঙ্কারির পর মনমোহন সিংহকে সরানোর জন্যও বিরাট চাপ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মনমোহনকে সরালে হয় প্রণববাবু কিংবা চিদম্বরমকে করতে হত। তাই মনমোহনকে সরাননি রাও। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন জমানাতে অর্থমন্ত্রী মাঝপথে বদল হতে দেখা গিয়েছে। মনমোহন জমানাতে চিদম্বরম ও প্রণব অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। এমনকী বাজপেয়ী জমানাতেও যশোবন্ত সিংহ ও যশবন্ত সিনহা অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন।

কিন্তু সদ্য দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে প্রকাশ্যে এক সাক্ষাৎকারে সুব্রহ্মণ্যম স্বামীকে ভর্ৎসনা করেছেন, তার পরেও জেটলিকে আক্রমণে ইতি টানেননি বিজেপির এই সাংসদ। গতকাল ফের টুইট করে প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রচারের শখ’-এর জবাব দিয়ে তিনি বলেছেন, তিনি প্রচার চান না। প্রচার তাঁর পিছনে ঘোরে। তাঁর বাড়ির সামনে ত্রিশটি টেলিভিশন চ্যানেল আর সংবাদ মাধ্যমের দুশোটি মিসড কল রয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর ‘মেরুদণ্ড’ রয়েছে বলে যে কোনও মূল্যে তাঁর পাশে থাকার কথা বলেছেন স্বামী, কিন্তু জেটলিকে ফের ‘অনির্বাচিত কুকুর’ অ্যাখ্যা দিয়ে অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, গত লোকসভা নির্বাচনে মোদী হাওয়া সত্ত্বেও জেটলি ভোটে জিততে পারেননি।

আরও পড়ুন: বেতনের ফারাক বেড়ে দ্বিগুণ, কেন্দ্রে উচ্ছ্বাস, রাজ্যে হতাশা

মোদীর ধমক সত্ত্বেও স্বামী যে ভাবে এখনও প্রকাশ্যে তোপ দাগছেন, তার পিছনে আরএসএসের প্রচ্ছন্ন সমর্থন না থাকলে যে এটি সম্ভব নয় সেটি বুঝছেন বিজেপি নেতারাও। তা না হলে বিজেপি নেতৃত্ব এত ক্ষণে তাঁকে বহিষ্কার করতেন। আরএসএস ঘনিষ্ঠ এস গুরুমূর্তি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের ইস্যুতে সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। জেটলিকে এত বার তোপ দাগলেও আরএসএসের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত স্বামীকে নিরস্ত্র করার কোনও চেষ্টা হয়নি। জেটলির সপক্ষেও আস্থা রেখে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।

কিন্তু বিজেপি-রই অনেক নেতা মনে করেন, আরএসএসের একটি অংশ স্বামীর পাশে থাকলেও জেটলির বিরুদ্ধে মোহন ভাগবত কিংবা সঙ্ঘে নেতৃত্বের উষ্মার কোনও কারণ হওয়ার কথা নেই। অর্থনীতির হাল ইউপিএ জমানা থেকে অনেক ভাল হচ্ছে, বৃদ্ধির হার বাড়ছে। তার উপর এই সরকার যে অর্থনীতির মডেল নিয়ে এগোচ্ছে, তাতেও স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের মতো সঙ্ঘের শাখার উদ্বেগের কারণ হতে পারে না। আর সব কিছুর উপরে প্রধানমন্ত্রীই পুরো রাশ ধরে রয়েছেন। আর্থিক উপদেষ্টাদের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীই বাজেটটা তৈরি করেন। ফলে অরুণ জেটলিকে আলাদা করে নিশানা করার সুযোগও কম।

এই অবস্থায় সঙ্ঘ নেতৃত্ব থেকে খুব চাপ এলে জেটলিকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে অর্থমন্ত্রকের ভার রাখতে পারেন। কিন্তু সেটিও প্রধানমন্ত্রী চান না। গোটাটাই তাঁর ঘাড়ে এসে পড়বে। ইউপিএ জমানাতে প্রতি বুধবার এক শিল্পপতি নিয়মিত প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসতেন। কিন্তু এখন অর্থমন্ত্রীর ভিজিটর রুম একেবারেই খালি থাকে। সেই ‘লবিস্ট’-এর দলও এখন উধাও নর্থব্লক থেকে। বিজেপির এক নেতা বলেন, এটা ঠিক, রাজ্যসভায় সুব্রহ্মণ্যম স্বামীকে নিয়ে আসার ব্যাপারে সঙ্ঘের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। আরএসএস নেতা কৃষ্ণগোপাল সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে স্বামীর নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু এখন স্বামীর ‘অরুণ-হঠাও’ অভিযান যতটা না স্বামীর ব্যক্তিগত বিষয়, ততটা আরএসএসের নয়।

তবে স্বামীর লাগাতার আক্রমণের মুখে অরুণ জেটলি এখন অনেকটাই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। এতটাই অসহিষ্ণু তিনি হয়ে রয়েছেন যে চিন থেকে ফিরে এসেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজের উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কথায় কথায় প্রশ্ন করেছেন, তা হলে কি আমার অর্থমন্ত্রক ছেড়ে দেওয়া উচিত? প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তাঁকে তখনই আশ্বস্ত করেন, সঠিক সময়েই তিনি সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করবেন। সে দিনই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী স্বামীকে ভর্ৎসনা করে জেটলির উপরেই প্রকাশ্যে আস্থা রাখেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE