Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Swachh Bharat Abhiyan

এলাকায় শৌচালয় গড়তে ভাঁড় ভেঙেছিল ‘লক্ষ্মী মেয়ে’, সেই মন্দ্রিতাই মোদীর স্বচ্ছ ভারতের দূত

পুজোপার্বণে খরচ করার জন্য মেয়েকে টাকা দিতেন বাবা। ২ বছর ধরে লক্ষ্মীভাঁড়ে জমানো ২৪ হাজার টাকা মন্দ্রিতা তুলে দিয়েছিল বাবার হাতে। অমিত সেই টাকা নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করেন।

লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে খুচরো, ১০, ২০, ১০০, পুরনো ৫০০ টাকা (নোটবন্দির আগে)-র নোট মিলিয়ে ২৪ হাজার টাকা নিয়ে মন্দ্রিতা তুলে দেয় বাবার হাতে।

লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে খুচরো, ১০, ২০, ১০০, পুরনো ৫০০ টাকা (নোটবন্দির আগে)-র নোট মিলিয়ে ২৪ হাজার টাকা নিয়ে মন্দ্রিতা তুলে দেয় বাবার হাতে। —নিজস্ব চিত্র।

সৈকত দাস
জামশেদপুর শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:২৯
Share: Save:

বয়স তখন কত আর হবে, নয়-দশ! চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া মেয়েকে খুব বকেছিলেন বাবা অমিত চট্টোপাধ্যায়। ওইটুকু মেয়ে। অত টাকা হাতখরচ নিয়ে করবে কী! জ্ঞান হওয়া ইস্তক সেই প্রথম বার বাবার কাছে বকুনি খেয়েছিল জামশেদপুরের টেলকো হিলটপ স্কুলের ছোট্ট ছাত্রী মন্দ্রিতা চট্টোপাধ্যায়। পরে বাবা যখন জানতে পারলেন মেয়ের ইচ্ছার কথা, তখন বিস্ময়ের অন্ত ছিল না তাঁর! এ ভাবেও ভাবা যায়!

২০১৬ সাল। মন্দ্রিতা তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে খুচরো, ১০, ২০, ১০০, পুরনো ৫০০ টাকা (নোটবন্দির আগে)-র নোট মিলিয়ে ২৪ হাজার টাকা নিয়ে মন্দ্রিতা তুলে দেয় বাবার হাতে। ওই টাকায় কাছাকাছির পঞ্চায়েত এলাকায় দু’টি শৌচাগার তৈরি হয়েছিল। বস্তুত, ওটাই ছিল আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম কেন্দ্রাডিহির প্রথম শৌচাগার। সাড়ে তিনশো বাসিন্দার ব্যবহারের জন্য শৌচাগার বানিয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী।

এখন মন্দ্রিতা দ্বাদশ শ্রেণি। তার জমানো টাকায় এ পর্যন্ত ১০টির বেশি শৌচাগার তৈরি হয়েছে। এ বারের ‘এডুগ্রাফ ১৮ আন্ডার ১৮’ পুরস্কার বিজেতাদের অন্যতম এই ছাত্রীর আইএএস অফিসার হওয়াই লক্ষ্য। বাণিজ্য শাখার ছাত্রী জানায়, সমাজসেবা করতে গিয়ে যে কাজ সে ঠিক মতো করে উঠতে পারছে না, আমলা হয়ে সে সবই করে দেখাতে চায়।

জামশেদপুরের টেলকো এলাকায় বাড়ি মন্দ্রিতাদের। অমিত বেসরকারি সংস্থার পদস্থ কর্তা। মা স্মৃতি স্থানীয় স্কুলের শিক্ষিকা। একমাত্র মেয়ের অভিনব কাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েন অমিত। ফিরে যান ৯ বছর আগের ঘটনায়। সালটা ২০১৪। সবে ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অমিতের কথায়, ‘‘আমি ল্যাপটপে কাজ করতে করতে খবর শুনতাম। তখন মেয়েও বসে বসে খবর শুনত। এক দিন কাজের সূত্রে কলকাতা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সকালে ট্রেন ধরব। ভোর সাড়ে ৫টা হবে, আমি বেরোচ্ছি দেখে ও দৌড়ে এল। বলল, ‘বাবা ১০০ টাকা দাও।’ দিলাম। কিন্তু পর পর দেখলাম ওর টাকার চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। যখন তখন আমার কাছে টাকা চাইছে। এটা খেয়াল করে সে দিন খুব বকাবকি করলাম ওকে।’’

এলাকায় শৌচাগার তৈরি, বর্জ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতার প্রচার করছে মন্দ্রিতা।

—নিজস্ব চিত্র।

বাবার কাছে বকা খাওয়া মেয়েকে আদর করে দিচ্ছিলেন মা। শুনতে চাইলেন, এত টাকা নিয়ে মেয়ে কী করতে চায়। কিছু কেনার আছে? মেয়ের কাছে জবাব পেয়ে চমকে গেলেন তিনি। মেয়ে জানায়, তার স্কুলে শৌচাগার নেই বলে কত সহপাঠিনী স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর কথা শুনেছে সে। তাই টাকা জমাচ্ছে। ওই টাকায় যেন গ্রামে কারও শৌচাগার হয়।

পুজোপার্বণে খরচ করার জন্য মেয়েকে টাকা দিতেন বাবা। ২ বছর ধরে লক্ষ্মীভাঁড়ে জমানো ২৪ হাজার টাকা মন্দ্রিতা তুলে দিয়েছিল বাবার হাতে। অমিত সেই টাকা নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করেন। পরে চেক নিয়ে তৎকালীন জেলাশাসক অমিত কুমারের সঙ্গে দেখা করেন।

অমিতের কাছে অমিতের মেয়ের ইচ্ছার কথা সব শুনে উপস্থিত সব সরকারি আধিকারিক তখন অবাক। কিন্তু সরাসরি এ ভাবে কারও কাছ থেকে টাকা নিয়ে কাজ করার মতো কোনও প্রকল্প তো নেই। তবে মন্দ্রিতার সচেতনতাকে দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখাতে তার লক্ষ্মীভাঁড়ের টাকা দিয়ে টেলকো কলোনি লাগোয়া আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম কেন্দ্রাডিহতে তৈরি হয় দু’টি শৌচাগার।

‘‘আমি একটা মন্দ্রিতা হয়ে যে কাজ করছি, আইএএস হয়ে অনেক মন্দ্রিতা এই রকম কাজ করতে পারবে।’’

‘‘আমি একটা মন্দ্রিতা হয়ে যে কাজ করছি, আইএএস হয়ে অনেক মন্দ্রিতা এই রকম কাজ করতে পারবে।’’ —নিজস্ব চিত্র।

সমাজসেবার সেই শুরু। এখন জামশেদপুরে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে কাজ করছে মন্দ্রিতা। সমানতালে চলছে আইএস হওয়ার প্রস্তুতি। অমিতের কথায়, ‘‘আমি বা স্ত্রী কেউই চাইনি যে, মেয়েকে ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় হতে হবে। সব সময় চেয়েছি ও ভাল মানুষ হোক।’’ মন্দ্রিতা চায় আইএএস হতে। বাবাকে সে বলেছে, ‘‘আমি একটা মন্দ্রিতা হয়ে যে কাজ করছি, আইএএস হয়ে অনেক মন্দ্রিতা এই রকম কাজ করতে পারবে।’’

এখন অমিত ও স্মৃতি নিজেদের রোজগারের বড় অংশ সরিয়ে রাখেন মেয়ের কাজের জন্য। মেয়েই তাঁদের কাছে অনুপ্রেরণা, বলছেন তাঁরা। এলাকায় শৌচাগার তৈরি, বর্জ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতার প্রচার করছে মন্দ্রিতা। মেয়ের এই কর্মযজ্ঞে বাবা-মা কাজ করছেন সেনাপতির মতো।

এডুগ্রাফ পুরস্কার নিয়ে মন্দ্রিতা বলে, ‘‘এই পুরস্কার শুধু আমায় দেওয়া হয়নি। আমার মনে হয় আমার মতো যারা এই রকম কাজ করছেন, তাঁদেরও পুরস্কৃত করা হল। আমার বাবা-মা, শিক্ষকদের এই পুরস্কার উৎসর্গ করছি।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Swachh Bharat Abhiyan inspiration Inspirational
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy