নিগমবোধ ঘাটে সাংবাদিক অক্ষয় সিংহের চিতার পাশে রাহুল গাঁধী। রবিবার নয়াদিল্লিতে। —নিজস্ব চিত্র।
ব্যপম-কাণ্ডে আবার এক রহস্য-মৃত্যু। যা শুধু মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের সমস্যাই দ্বিগুণ করে দিল না, আরও জলে ঠেলে দিল নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকারকে।
মধ্যপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারির খবর সংগ্রহে গিয়ে গত কালই মারা গিয়েছেন সাংবাদিক অক্ষয় সিংহ। তার চব্বিশ ঘণ্টা যেতে না যেতেই আজ সকালে আরও একটি রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা সামনে এল খাস রাজধানীতে। দক্ষিণ পশ্চিম দিল্লির এক হোটেল থেকে দেহ উদ্ধার হল জবলপুরের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মেডিক্যাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মার। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ব্যপম কেলেঙ্কারিতে তাঁর কলেজেও নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে কি না, ডিন হিসেবে অরুণ তারই তদন্ত করছিলেন।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এমনিতেই রাহুর দশা চলছে বিজেপি নেতৃত্ব তথা মোদী সরকারের। একের পর এক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছেন কেন্দ্রীয় সরকারের নেতা-মন্ত্রী এবং বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। এর উপরে গত কাল ও আজ মিলিয়ে পরপর দু’টি এবং তার আগের ধারাবাহিক অস্বাভাবিক মৃত্যুর জেরে ব্যপম ভর্তি ও নিয়োগ কেলেঙ্কারি ঘিরে ক্রমেই যে শুধু রহস্যের জাল ছড়াচ্ছে তা নয়। কেন্দ্রের সরকার ও শাসক দলের সঙ্কটও বাড়াচ্ছে পাল্লা দিয়ে।
জমি বিল বা আর দশটা বিষয়ের মতো এই কেলেঙ্কারিও এখন বিজেপি এবং মোদী সরকারের বিরুদ্ধে এককাট্টা করে তুলছে বিরোধীদের। আজ নিগমবোধ ঘাটে সাংবাদিক অক্ষয়ের শেষকৃত্যে হাজির ছিলেন রাহুল গাঁধী এবং অরবিন্দ কেজরীবাল। সরকারকে কোণঠাসা করার এমন সুযোগ স্বাভাবিক ভাবেই হাতছাড়া করতে চাইছে না কংগ্রেস। এবং আপ-ও। অন্য বিরোধীরাও সরব হয়েছে ব্যপম কেলেঙ্কারিতে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের দাবিতে।
ব্যপম কেলেঙ্কারি কী
মধ্যপ্রদেশে টাকার বিনিময়ে ভর্তি ও নিয়োগের এক বিশাল চক্র।
দালাল থেকে ছোট-বড় সরকারি আমলা ও প্রভাবশালী বহু নেতা-মন্ত্রী জড়িত।
আক্রমণে যাওয়ার জন্য কংগ্রেস খোলা মাঠ পেয়ে যাচ্ছে বুঝে ক্ষত মেরামতের জন্য আজ মাঠে নেমেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহরা। সুর নরম করেছেন শিবরাজও।
গত কালের সাংবাদিক মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলে জেটলি আজ টুইট করেছেন, ‘‘যে-হেতু এই মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু বিষয় উঠে এসেছে, তাই খুবই নিরপেক্ষ একটি তদন্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজন, যাতে সমস্ত সন্দেহের অবসান ঘটে।’’ অন্য দিকে শিবরাজের সঙ্গে ফোনে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলেছেন রাজনাথ। গোটা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন তিনি। ব্যপম কাণ্ডের তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনও রকম সাহায্য দেবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন রাজনাথ। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, ব্যপম-কেলেঙ্কারি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাজনাথ আজ শিবরাজের কাছে নিজের অসন্তোষ গোপন করেননি। ঘরে-বাইরে আক্রমণের মুখে পড়ে দৃশ্যতই কিছুটা নড়বড়ে শিবরাজ। গত কালের অবস্থান থেকে সরে এসে তিনি আজ জানিয়েছেন, হাইকোর্ট যদি মনে করে সিবিআই বা অন্য কোনও তদন্তকারী সংস্থার হাতে ব্যপম কাণ্ডের তদন্তভার তুলে দেবে, সে ক্ষেত্রে তাঁর সরকার আপত্তি করবে না। গত কালও সাংবাদিকের মৃত্যুর পর মধ্যপ্রদেশ সরকারকে আক্রমণ করে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু তখন শিবরাজ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন কোনও অবস্থাতেই এই কাণ্ডের তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। তাঁর যুক্তি ছিল, হাইকোর্টের নজরদারিতে টাস্ক ফোর্স এই দুর্নীতির তদন্ত করছে। অথচ আজই সাংবাদিক বৈঠক করে শিবরাজ জানিয়েছেন, সিবিআই তদন্তে তাঁদের আপত্তি নেই। এমনকী, অক্ষয়ের ভিসেরা দিল্লিতে এইমস হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করানোর বিষয়েও আজ সম্মতি জানিয়েছে তাঁর প্রশাসন। অক্ষয়ের আত্মীয়রা এই দাবি তুলেছিলেন।
চাপের মুখে শিবরাজ কিছুটা গুটিয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রী মোদী এখনও অনড় অবস্থান নিয়েই চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রের খবর, বিরোধী বা সংবাদমাধ্যমের দাবি মেনে মন্ত্রিসভায় কোনও বড় রকমের রদবদল করতে চাইছেন না তিনি। অথচ আর দু’সপ্তাহ পরে সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হতে চলেছে। বিরোধী ঝড়ে গোটা অধিবেশনই বানচাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও তাই ক্রমশ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরানোই বিজেপির অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ছে। কেন-না বিরোধীরা এককাট্টা হলে থমকে যেতে পারে মোদীর সংস্কারের চাকা।
শাসক-বিরোধী উভয় শিবিরের নেতারাই মানছেন, ব্যপম-কেলেঙ্কারি বিতর্কের আগুনে সাম্প্রতিকতম সংযোজন মাত্র। ললিত মোদী বিতর্ক এখনও টাটকা। তার জেরে তোপের মুখে পড়েছেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে। ললিত-কাণ্ড বাদ দিলেও সম্প্রতি একের পর এক ঘটনায় সামগ্রিক ভাবে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের ভাবমূর্তিতে কালির দাগ লাগছে। ৩৬ হাজার কোটি টাকার চাল কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহের বিরুদ্ধে। তাঁর ইস্তফার দাবিতে সরব হয়েছে কংগ্রেস। অন্য দিকে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রধান পদে গজেন্দ্র চৌহানের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। দলীয় সাংসদ হেমা মালিনীর গাড়ির ধাক্কায় শিশু-মৃত্যু নিয়েও দেশ জুড়ে ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে প্রতিক্রিয়া প্রবল। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজুর ‘বিমান-কাণ্ডের’ পর বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের ‘ভিআইপি-তন্ত্র’ প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। যার সূত্রে ‘সরকারের কর্তাদের সাদামাঠা জীবন কোথায়’— এই প্রশ্ন তুলে মোদী নিজেও অসন্তোষ গোপন করেননি। মহারাষ্ট্রেরই আর এক মন্ত্রী পঙ্কজা মুণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি দরপত্র ছাড়াই রাজ্যের স্কুলগুলির জন্য ২৪টি সংস্থাকে একই দিনে ২০৬ কোটি টাকার জিনিস কেনার বরাত দিয়েছেন!
বিজেপির পাল্টা অভিযোগ, মোদী সরকারের সংস্কারের পদক্ষেপ আটকাতেই রাজ্যের বিষয়গুলিকে রাজধানীতে নিয়ে আসছেন বিরোধীরা। কিন্তু মোদী যে ‘জাঁতাকলে’ পড়েছেন, তা বুঝতে পারছে দলের একটি বড় অংশ। বুঝছেন মোদীও।
এই সংক্রান্ত আরও খবর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy