অর্থনীতির যুক্তি বলছে, স্বচ্ছল, ধনীদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র গরিবদেরই ভর্তুকি দেওয়া উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক যুক্তি বলছে, ভর্তুকি নিয়ে ভেদাভেদ করতে গেলেই ধনী ও সচ্ছলদের রোষের মুখে পড়তে হতে পারে। ভর্তুকির বোঝা কমাতে গিয়ে এই উভয় সঙ্কটে পড়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
রান্নার গ্যাস হোক বা কেরোসিন, জল হোক বা বিদ্যুত্— গরিবদের কথা ভেবে ভর্তুকি দেওয়া হলেও আখেরে তাতে লাভ হচ্ছে ধনী অথবা সচ্ছলদের। যাদের ওই ভর্তুকির আদৌ প্রয়োজন নেই। এ বারের আর্থিক সমীক্ষায় মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম সে কথাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধনী-সচ্ছলদের ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়ার রাজনৈতিক সাহসও দেখাতে পারছে না সরকার। ফলে কারখানার শ্রমিক যে দামে রান্নার গ্যাস পাচ্ছেন, সেই একই দামে রান্নার গ্যাস পাচ্ছেন কারখানার মালিকও।
ইউপিএ সরকারের আমলে সনিয়া গাঁধীর ভর্তুকি-খয়রাতি নীতির সমালোচনা করেই ক্ষমতায় এসেছেন নরেন্দ্র মোদী। অর্থনীতিবিদরা আশা করেছিলেন, শক্ত হাতে ভর্তুকি কমিয়ে আর্থিক বৃদ্ধিতেই বেশি করে জোর দেবে মোদী সরকার। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন, ভর্তুকি একেবারে তুলে দিলে মোদী সরকার গরিব-বিরোধী বলে বার্তা যাবে। চলতি বছরের বাজেট পেশের পরও অরুণ জেটলি তাই বলেছেন, “ভারতে কোনও সরকারই ভর্তুকির পুরোপুরি বিরোধিতা করতে পারে না। যাদের ভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন, তাদের আমরা ভর্তুকি দিতে থাকব।” কিন্তু যাদের ভর্তুকির দরকার নেই? সেখানে অপ্রিয় হলেও কড়া পদক্ষেপের প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা।
এই কড়া পদক্ষেপ করা নিয়েই দ্বিধায় মোদী সরকার। মোদী-জেটলিরা সবার আগে রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। গত কয়েক দিনে একাধিক বারই তাঁরা অনুরোধ রেখেছেন, ধনী-সচ্ছলরা নিজে থেকেই ভর্তুকি ছেড়ে দিন। গোটা দেশে এলপিজি সংযোগ রয়েছে ১৫ কোটির বেশি। এ পর্যন্ত মাত্র ২ লক্ষ ৮০ হাজার জন ভর্তুকি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। এটা অন্তত ১ কোটি হোক, চাইছে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক। কিন্তু লক্ষ্য পূরণ হবে কি? নিশ্চিত নন মন্ত্রকের কেউ।
কারণ, গ্রাহকরাও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন। স্বেচ্ছায় ভর্তুকি ছেড়ে দেওয়ার আর্জি রাখছে সরকার। কিন্তু আয় ঠিক কত হলে ভর্তুকি না নেওয়াই সঙ্গত, সেই কথাটি কেউ বলছে না। ফলে অন্যেরা চুপিচুপি নেবে, আমিই বা নেব না কেন— গ্রাহকদের পক্ষে এমনটা ভাবা যে অস্বাভাবিক নয়, মানছেন মন্ত্রকের কর্তারাও। প্রশ্ন রয়েছে আরও। ভর্তুকি ছেড়ে দেওয়ার পরে কোনও কারণে বা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ায় আয় কমে গেলে, তখন কি ভর্তুকি পাওয়ার রাস্তা খোলা থাকবে? এটা জানানো হচ্ছে না। মোদী-জেটলির ভর্তুকি ছাড়ার ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রশ্নে এই দিকগুলি ভাবাচ্ছে সচ্ছলদেরও। ফলে এ ভাবে ভর্তুকি ছেড়ে দেওয়া মানুষের সংখ্যাটা ১ কোটি পৌঁছনো তো দূর, আদৌ খুব বেশি এগোনো যাবে কি না তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের কর্তারাই। জেটলি অবশ্য বলছেন, “আমরা ধনী ও সচ্ছলদের নিজে থেকেই ভর্তুকি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছি। এটা প্রথম ধাপ। পরের ধাপে ভর্তুকি কমানোর কিছু পদক্ষেপ করতে হবে।”
আর্থিক সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয়েছে, জন-ধন যোজনায় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, আধার কার্ড ও মোবাইল নম্বর— এই ত্রিফলার সাহায্য নিয়ে কাদের ভর্তুকি দরকার, কাদের নয় তা চিহ্নিত করে ফেলা হোক। তার পর গরিবদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ভর্তুকি পৌঁছে দেওয়া হোক। ইউপিএ আমলেই সরাসরি ভর্তুকি হস্তান্তরের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহরা ধনীদের ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়ার সাহস দেখাননি। মোদী-জেটলিরাও সেই সাহস দেখানোর কথা ভাবতে পারছে না।
তার ফল কী হচ্ছে? মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমের যুক্তি, কেরোসিন, এলপিজি, জল, বিদ্যুত্ থেকে সার, সব ভর্তুকির সুবিধা বেশি পাচ্ছেন ধনী-সচ্ছলরাই। যেমন, গরিবরা জ্বালানি হিসেবে কেরোসিন ব্যবহার করেন, এমন ধারণা থেকেই কেরোসিনে ভর্তুকি দেওয়া হয়। কিন্তু আর্থিক সমীক্ষা বলছে দারিদ্রসীমার নীচের মাত্র ৪৬% মানুষ কেরোসিন কেনেন। ৫১% কেরোসিন যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের মোটেই গরিব বলা যায় না। ভর্তুকিতে দেওয়া সস্তার কেরোসিনের ১৫% ব্যবহার করেন একেবারে ধনীরা।
ভর্তুকিতে দেওয়া রান্নার গ্যাসের সিকি ভাগ নেন নিম্ন আয়ের মানুষ। জলে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা-ও সচ্ছলদের বাড়িতেই পৌঁছয়। গরিব পরিবারের শতকরা ৬০ ভাগই রাস্তার কলের জল ব্যবহার করেন। সারের ভর্তুকিতেও যত না কৃষকদের লাভ হচ্ছে, তার থেকে বেশি ফায়দা কুড়োচ্ছে ইউরিয়া ও অন্য সার উত্পাদনকারীরা।
অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমের বক্তব্য, “ভর্তুকি দিলে গরিব মানুষের জীবনযাত্রার কোনও উন্নতি হয় না। মূল্যবৃদ্ধির হার খুব বেশি হলে কিংবা বাজারদর ওঠানামা করলে ভর্তুকিতে কিছুটা সুবিধা হয়। কিছুটা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, ভর্তুকির অস্ত্রে দারিদ্রের মোকাবিলা করা যায় না।” তা হলে উপায়? তাঁর দাওয়াই, প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনায় দেশের প্রায় সব পরিবারেই একটি করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে আধার ও মোবাইল নম্বর যুক্ত করলে যাঁদের ভর্তুকি দেওয়া দরকার, তাদের কাছে খুব সহজেই ভর্তুকি পৌঁছে দেওয়া যায়। আলাদা করে কেরোসিন, বিদ্যুত্ বা চাল-গমে ভর্তুকি না দিয়ে প্রতি মাসে একসঙ্গে কিছু টাকা আর্থিক সাহায্য গরিব পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব।
মোদী সরকারের চ্যালেঞ্জ হল, কারা সেই আর্থিক সাহায্য পাবেন আর কারা পাবেন না, সে বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়া। মোদী-জেটলি কবে সেই সাহস দেখাতে পারেন, এখন সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy