সাংবাদিক বৈঠকে প্রাক্তন পাক বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরির সঙ্গে সুধীন্দ্র কুলকার্নি। সোমবার মুম্বইয়ে। ছবি: পিটিআই
শিবসেনার তাণ্ডবের মুকুটে আরও একটা পালক!
মাত্র ক’দিন আগেই তাদের হুমকিতে মুম্বইয়ে গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে পাকিস্তানের গজল গায়ক গুলাম আলির অনুষ্ঠান। এ বার আর এক পাকিস্তানি, প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরির একটি বই প্রকাশকে ঘিরে অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটাল শিবসেনা। অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা, লালকৃষ্ণ আডবাণীর ঘনিষ্ঠ সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি মাখিয়ে দিল তারা।
স্বাভাবিক ভাবেই, এর পরে প্রশ্ন উঠে গেল অসহিষ্ণুতা নিয়ে। সলমন রুশদি থেকে আডবাণী বা মহেশ ভট্ট— প্রত্যেকেই একই দিকে আঙুল তুলেছেন। এবং তুলে এনেছেন সাম্প্রতিক দাদরি-হত্যা প্রসঙ্গও। গুজবের জেরে সেখানে গণপিটুনিতে এক প্রৌঢ়ের মৃত্যুর ঘটনা যে ভারতের বহুত্ববাদী নীতিকেই আঘাত করে, সেটা বলছেন অনেকেই। দাদরির পরেই প্রতিবাদে সাহিত্য অকাদেমি ছাড়েন নয়নতারা সহগল। পুরস্কার ত্যাগের তালিকাও কম নয়। অসহিষ্ণুতার দিকে আঙুল তুলে এবং নয়নতারার পাশে দাঁড়িয়ে টুইটারে সরব হয়েছেন রুশদি— ‘‘ভারতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার এখন বিপন্ন দশা।’’ কুলকার্নির মুখে কালি লেপে দেওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে আডবাণীও প্রায় রুশদির সুরেই বলেছেন, ‘‘কোনও মত পছন্দ না হলেই হিংসাত্মক আচরণ হচ্ছে। এটা দেশের পক্ষে উদ্বেগের।’’
লালকৃষ্ণ আডবাণী: আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। গণতন্ত্রে সব সময় অন্য মতামতের জায়গা থাকা উচিত।
কী ঘটেছিল সোমবার সকালে?
গেরুয়া-সবুজ কুর্তা আর বুকে তেরঙ্গা নিয়ে সকালবেলায় বাড়ি থেকে বেরোতেই সুধীন্দ্র কুলকার্নির গাড়ি আটকে তাঁর মুখে কালি লেপে দেওয়া হয়। এক সময় বাজপেয়ী-আডবাণীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সুধীন্দ্রের সঙ্গে মোদী জমানায় দূরত্ব তৈরি হয়েছে বিজেপির। এখন তিনি ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান। এবং তাঁর উদ্যোগেই আজ মুম্বইয়ে নিজের লেখা একটি বই প্রকাশ করতে এসেছেন কাসুরি। সেই বই প্রকাশের বিরোধিতা করতেই বিজেপির জোট সঙ্গী শিবসেনার এই ‘হামলা’! যা কিনা শিবসৈনিকদের ভাষায়, ‘‘পাক সন্ত্রাসবাদের হামলা ভুলে কুলকার্নির মতো ‘পাক-এজেন্ট’-এর মুখে কালি লেপে গণতান্ত্রিক ও অহিংসার পথই নেওয়া হয়েছে!’’ পরে এই ঘটনায় ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রশ্ন হল, এই ঘটনায় আদতে কার মুখে কালি পড়ল?
শুধু কি কুলকার্নি নামক এক ব্যক্তির মুখে? নাকি কেন্দ্রের সরকার? নাকি এ দেশের সহিষ্ণুতার?
উত্তরটা জানা নেই কারও। কারণ কেন্দ্রে সরকারে থাকা বিজেপির নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের মতো শীর্ষ নেতারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। যেমনটা তাঁরা চুপ ছিলেন গুলাম আলির অনুষ্ঠান বানচালের সময়। বিক্ষিপ্ত ভাবে নিতিন গডকড়ী বা কয়েক জন ছোটো-খাটো নেতা মন্তব্য করলেও দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এর বিরোধিতা করা হয়নি। তবে আডবাণী সরব হয়েছেন। যদিও তাতে এখন আর কী এসে যায়— এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপিরই অনেকে! সন্ধ্যায় মুম্বইয়ে বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের জন্য মহারাষ্ট্রের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস বেনজির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি শিবসেনার সমালোচনাও করেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গেই তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তাতে অন্য সুর শুনছেন অনেকেই। দেবেন্দ্র বলেছেন, ‘‘এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কোনও ভারত-বিরোধী প্রচার সহ্য করা হবে না। যদি তা হতে দেখা যায়, তা হলে আয়োজকরা দায়ী হবেন।’’
এখানেই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি শিবসেনা যে প্রতিবাদ দেখাচ্ছে, তার পিছনে বিজেপি নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে?
কংগ্রেস ঠিক এই অভিযোগটিই করছে। শিবসেনাকে ‘দেশি তালিবান’ বলে বিদ্রুপ করেছে তারা। একই সঙ্গে দলের নেতা অজয় কুমারের বক্তব্য, এটা পুরোটাই বিজেপি ও শিবসেনার ম্যাচ গড়াপেটা। বিহারে যখন ভোট হচ্ছে, ঠিক তখন পাক-বিরোধিতার জিগির তুলে শিবসেনার ঘাড়ে বন্দুক রেখে বিজেপি আসলে ধর্মীয় মেরুকরণের পথে হাঁটছে। কংগ্রেসের বক্তব্য, গুলাম আলি অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন শান্তির বার্তা নিয়ে। কাসুরিও শান্তির দৌত্য করতেই এসেছেন। শিবসেনার তীব্র নিন্দা করেছে সিপিআই, সিপিএম-সহ অন্য একাধিক দলও।
আর কুলকার্নি নিজে? মুখে শিবসৈনিকদের মাখানো কালি নিয়েই সন্ধ্যায় কাসুরির বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে যান। তাঁর মন্তব্য, ‘‘কালি শুধু আমার মুখে নয়, তেরঙ্গাতেও লাগানো হয়েছে!’’ কথা প্রসঙ্গে টেনে আনেন আডবাণীর পাকিস্তান সফরের কথা। জানান, কাসুরির বইয়ে আডবাণীর সফর নিয়ে ইতিবাচক কথাই লেখা হয়েছে। যে পাকিস্তান সফরে জিন্নার প্রশস্তি করে এক সময় আডবাণীকে দলে বড় মূল্য চোকাতে হয়েছিল! কাসুরি নিজেও গোটা ঘটনায় স্তম্ভিত। সন্ধ্যায় বই প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘‘এই বইয়ে ভারত-পাক শান্তি প্রক্রিয়ার কথাই লেখা হয়েছে। অনেক ভুল ধারণা দূর করতে চেয়েছি।’’ প্রাক্তন পাক বিদেশমন্ত্রীর দাবি, সত্য ও ইতিবাচক কথা বললে দু’দেশের মধ্যে আস্থা আরও বাড়বে।
এ দিনের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন এ জি নুরানি, দিলীপ পদগাঁওকর, নাসিরুদ্দিন শাহের মতো অনেকেই। মুখে কালি নিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া না মিললেও চুপ করে থাকেনি বলিউড। শাবানা আজমি থেকে মহেশ ভট্ট— সরব অনেকেই। ক্ষুব্ধ শাবানা ফোনও করেছিলেন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে এবং তাঁর ছেলে আদিত্য ঠাকরেকে। কিন্তু শাবানার ফোন ওঁরা ধরেনইনি!
সমালোচনার মুখেও অনড় শিবসেনা। এমন কাজে গর্বিত তারা! উদ্ধব ঠাকরের ছেলে আদিত্য বলেন, ‘‘কালি এমন ব্যক্তির মুখেই লেপা হয়েছে, যিনি নকশালদের সহমর্মী। যে প্রাক্তন পাক বিদেশমন্ত্রীকে এনেছেন, তাঁর সঙ্গে উপত্যকার ভারত-বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির যোগ রয়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, তাই কাল কুলকার্নি উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে দেখা করে এলেও শিবসৈনিকদের আজ নিরস্ত করা যায়নি। বাল ঠাকরে জীবিত থাকতেও শিবসেনা এমন উগ্র ছিল। পাক ক্রিকেট দলের খেলা আটকাতে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পিচ খুঁড়েছিল! তখন বাল ঠাকরের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন আডবাণী। এখন জমানা বদলেছে। শিবসেনার দাপটও আর নেই। তবু নরেন্দ্রমোদী-অমিত শাহের জমানায় তাদের নিরস্ত করার উদ্যোগই নেই। কংগ্রেসের ভাষায় যা, ‘‘সঙ্ঘের আদর্শের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে বিজেপিতে। নাগপুর থেকে রিমোট কন্ট্রোলে সঙ্ঘই তো চালাচ্ছে সবটা!’’
সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।
• কুলকার্নি বললেন এটা গণতন্ত্রের প্রতি আক্রমণ, নিন্দায় সরব আডবাণীও
• কুলকার্নির মুখে কালি, গোটাটাই কি বিজেপি-সেনার গড়াপেটা ম্যাচ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy