তাণ্ডব: জেএনইউ চত্বরে দুষ্কৃতীরা (বাঁ দিকে)। রক্তাক্ত জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ (মাঝে)। জখম অধ্যাপিকা সুচরিতা সেন এমসে। রবিবার। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া
কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা। হাতে মোটা লাঠি, লোহার রড। শ’খানেক মুখোশধারীর মিছিল চলেছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের রাস্তা ধরে। প্রথমে ভিড়টা জড়ো হল সাবরমতী ধাবার সামনে। হস্টেলে ঢুকে লাঠি-রড উঁচিয়ে ছাত্রছাত্রীদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হল। তার পর ধেয়ে এল গুন্ডাবাহিনী। পড়ুয়াদের উপরে হামলা চলল। বাদ গেলেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। ভাঙচুর হল হস্টেলে। পুলিশ দাঁড়িয়ে রইল নীরব দর্শকের মতো। তাদের চোখের সামনেই এই তাণ্ডব চলল। রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।
রবিবার সন্ধ্যায় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এ এই হামলার ঘটনায় ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ-সহ একাধিক ছাত্রছাত্রী আহত হয়েছেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে মার খেতে হয় জেএনইউয়ের ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট’-এর অধ্যাপিকা সুচরিতা সেন-সহ একাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে। সুচরিতাকে এমস-এ ভর্তি করতে হয়েছে।
BREAKING NEWS from #JNU#Media, civil society people move quickly to Jawaharlal Nehru University in Delhi right now.
— Natasha Badhwar (@natashabadhwar) January 5, 2020
There are masked, armed persons entering hostels and attacking students.
Video of Aishe Ghosh, President, JNUSU injured in attack. pic.twitter.com/JmAKobWRji
গোটা ঘটনায় অভিযোগের আঙুল সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র দিকে। পড়ুয়াদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও অভিযোগ, দিল্লি পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মদতে এবিভিপি-র সদস্যেরা মুখ ঢেকে ক্যাম্পাসে ঢুকে এই হামলা করেছে। জেএনইউয়ের ছাত্রছাত্রীরা বর্ধিত হস্টেল ফি-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও পরীক্ষার জন্য নাম নথিভুক্তিকরণ বয়কট করছিলেন। এর পরে নয়া নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধেও দিল্লিতে যাবতীয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পুরোভাগে ছিল জেএনইউ। তার জেরেই এই পরিকল্পিত হামলা হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। জেএনইউয়ের এবিভিপি সভাপতি দুর্গেশ কুমারের পাল্টা অভিযোগ, বামেরাই হামলা চালিয়েছে। আর জেএনইউ কর্তৃপক্ষের দেওয়া লিখিত বিবৃতিতে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদেরই সিংহভাগ দোষারোপ করা হয়েছে। মুখোশধারীদের হামলার প্রসঙ্গ সেই বিবৃতিতে রয়েছে নামমাত্র।
ঘটনার পরে রক্তাক্ত অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে ঐশী বলেন, ‘‘আমাকে নৃশংস ভাবে মারধর করা হয়েছে। আমি কথা বলার অবস্থাতেই নেই।’’ প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ১৮ জন পড়ুয়াকে এমস-এ ভর্তি করা হয়েছে। অন্তত দু’জনের অবস্থা গুরুতর। শুধু হস্টেল নয়, ক্যাম্পাসে গাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়। পাথর ছোড়া হয়। মেয়েদের হস্টেলে অ্যাসিড নিয়েও হামলার চেষ্টা হয় বলে অভিযোগ।
ভিতরে যখন হামলা চলছে, তখন গেটের বাইরে স্লোগান ওঠে ‘গোলি মারো শালো কো’, ‘ভারত মাতা কি জয়’, ‘জয় শ্রী রাম’। দিল্লির পুলিশ অমিত শাহের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল তাই পুলিশকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিতে দিল্লির উপরাজ্যপাল অনিল বৈজলের সঙ্গে কথা বলেন। উপরাজ্যপাল বিবৃতি দিয়ে জানান, তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। অমিত শাহ দিল্লির পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়কের সঙ্গে কথা বলে জেএনইউয়ের বিষয়ে জানতে চান। যুগ্ম কমিশনার
পর্যায়ের অফিসারকে দিয়ে ঘটনার তদন্ত করিয়ে যত দ্রুত সম্ভব রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ঘটনার নিন্দা করেছে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকও।
পড়ুয়াদের অবশ্য অভিযোগ, দিল্লি পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদতেই পরিকল্পিত হামলা করেছে এবিভিপি। বিকেল থেকেই ক্যাম্পাসে ভিড় জমতে শুরু করে। মুখোশধারী গুন্ডারা প্রথমে সাবরমতী ধাবার বাইরে জড়ো হয়। পড়ুয়াদের অভিযোগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবিভিপি নেতা-নেত্রীরা ভাড়াটে গুন্ডাদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে আসেন। রড, লাঠি, বাঁশ নিয়ে পড়ুয়াদের উপরে চড়াও হয় তারা। হস্টেলের আলো নিভিয়ে দিয়ে হামলার পাশাপাশি সাবরমতী, কাবেরী, পেরিয়ার হস্টেলে ভাঙচুরও চলে। পড়ুয়াদের অভিযোগ, আরএসএস-ঘনিষ্ঠ কয়েক জন শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন। ঘটনার পরে দিল্লি পুলিশের সদর দফতরের বাইরে এবং বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ শুরু হয়।
ঐশীর সঙ্গে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সতীশচন্দ্র যাদবও গুরুতর আহত হন। গোটা ঘটনা হয়ে যাওয়ার পরে পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢোকে। জেএনইউয়ের রেজিস্ট্রার প্রমোদ কুমার বলেছেন, ক্যাম্পাসে মুখোশধারী দুষ্কৃতীরা ঢুকে পড়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনি পুলিশ ডাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পুলিশ ক্যাম্পাসে অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকতে দেয়নি। ঘটনার পরে জেএনইউয়ের বাইরে এক কিলোমিটার পর্যন্ত রাস্তায় আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষ বলেন, ‘‘পুরোপুরি পরিকল্পিত হামলা। বিকেলে গুন্ডাদের জড়ো করা হয়েছিল। তারা নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। আগে থেকেই পুলিশ বাইরে অপেক্ষা করছিল।’’ শিক্ষক অতুল সুদের কথায়, ‘‘বর্ধিত ফি প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা নৈতিক ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। পরীক্ষা বয়কটের দাবি থেকে তারা সরেনি। যারা হামলা করেছে, তাদের আমি চিনতে পারিনি। ওদের হাতে বড় বড় পাথরও ছিল, যাতে আমাদের মাথা ফেটে যেতে পারত। এক বার আমি পড়ে যাই। বেরিয়ে দেখি, আমার গাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে ওরা।’’
পড়ুয়াদের যুক্তি, ফি নিয়ে আন্দোলনে চিড় ধরাতে কর্তৃপক্ষ ক্রমশ মরিয়া হচ্ছিলেন। ‘নাম নথিভুক্ত না-করলে পরের সেমেস্টার দেওয়া যাবে না’ বলে হুমকিতেও কাজ হয়নি। এর পরেই বলপ্রয়োগ শুরু হয়। সঙ্গত করে এবিভিপি। কখনও প্রশাসনিক ভবনের সামনে যাঁরা শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের জোর করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কখনও হস্টেলের আলো মাঝরাতে বন্ধ করে দিয়ে পড়ুয়াদের একাংশের গায়ে হাত তোলা হয়েছে। ছাত্র-নেতারা প্রতিবাদ করলে তাঁদেরও রেয়াত করা হয়নি। এর মধ্যেই নির্দেশ বলবৎ হয়, হস্টেল ফি না-দিলে চলে যেতে হবে। তা নিয়েও পড়ুয়ারা এককাট্টা ছিলেন।
দিন দুয়েক আগেই অভিযোগ ওঠে, ঐশীকে সকলের সামনেই থাপ্পড় মেরেছিলেন এক রক্ষী। দুর্গাপুরের ডিটিপিএল কলোনির বাসিন্দা ঐশীর মা শর্মিষ্ঠাদেবী বলেন, ‘‘ঐশীর সঙ্গে সরাসরি এখনও যোগাযোগ হয়নি। শুনেছি, পাঁচটা সেলাই পড়েছে। ঐশীরা ওদের আগামিকালের এক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করছিল। সেই সময়েই মেয়ে আর ওর সঙ্গীদের উপরে রড নিয়ে হামলা চালানো হয়। মেয়েকে দেখে উদ্বেগে রয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy