মঞ্চে তখন তোড়জোড় চলছে বিদায়ী পলিটব্যুরো সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়ার। নতুন সদস্যদের ঘিরে ঘিরে জটলা জমছে। তারই মধ্যে নীরবে মঞ্চ থেকে নেমে ‘এগ্জিট’ লেখা ফটকের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। প্রতিনিধিদের জন্যে দেওয়া ঝোলা ব্যাগটাও পড়ে রইল মঞ্চের টেবিলেই!
এত তাড়া কেন? ছবি তুলতে চাইছে তো অনেকে! ডাক শুনে এক বার থমকে দাঁড়াল চেহারাটা। পরিচিত স্মিত হাস্যে জবাব, ‘‘মাই টাইম ইজ় ওভার, মাই ফ্রেন্ড!’’ বাঁ হাতটা ট্রাউজ়ারের পকেটে ঢুকিয়ে ‘এগ্জিট’ লেখা সাইন বোর্ডের তলা দিয়ে গলে গেলেন প্রকাশ কারাট।
মাদুরাই পার্টি কংগ্রেসের অন্তিমে প্রতীকী হয়ে থাকল দৃশ্যটা। সিপিএমের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদকের স্মৃতিতে যে সভাস্থলের নাম হয়েছে ‘সীতারাম ইয়েচুরি নগর’, তারই মঞ্চে দলের শীর্ষ স্তরে দীর্ঘ ইনিংস শেষ হয়ে গেল কারাটের। ইএমএস-এইচকেএস জমানার পরে ভারতে সিপিএম বলতে যে কারাট-ইয়েচুরির জুড়ি বোঝাত, তাতে ভাঙন ধরে গিয়েছে গত সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় জনের প্রয়াণে। প্রথম জনও এ বার অবসরে গেলেন। সিপিএমে অবসান হয়ে গেল একটা জমানার।
দলের ২৪তম পার্টি কংগ্রেস থেকে সিপিএমের নেতৃত্বের ব্যাটন উঠল মারিয়ম আলেকজ়ান্ডার বেবির হাতে। কারাট ও ইয়েচুরির পরে তিনিও দক্ষিণী। তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। অতীতে রাজ্যসভার সাংসদ থেকেছেন, কেরলে শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন, বিরোধী দলের বিধায়ক হিসেবেও কাজ করেছেন। লোকসভা ভোটে প্রার্থী হয়ে হেরেওছেন। ভোটের রাজনীতিতে অভ্যস্ত, মৃদুভাষী, ঠান্ডা মাথার এক নেতাকে ইয়েচুরির ফেলে যাওয়া আসনে নিয়ে এল সিপিএম।
সেই প্রক্রিয়া অবশ্য খুব মসৃণ হয়নি। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের আগে বিদায়ী পলিটব্যুরোর বৈঠকে বেবির নামে সহমত ছিল না। সূত্রের খবর, বাংলার তিন জন-সহ পলিটব্যুরোর অন্তত আধ ডজ়ন নেতা চাইছিলেন কৃষক সভার অশোক ধওয়েলে নতুন সাধারণ সম্পাদক হোন। কেরল ছিল বেবির পক্ষেই। শেষ পর্যন্ত কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন তাঁর পুরনো আপত্তি সরিয়ে বেবির পক্ষে মত দেন। আর বাংলা-সহ বাকি অংশের আপত্তি মেনে ঠিক হয়, একমাত্র বাম-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন বাদে কাউকেই বয়স-বিধিতে ছাড় দিয়ে ‘ব্যতিক্রম’ করা হবে না।
বিজয়নকে রেখে এই রফা করতে গিয়ে পলিটব্যুরোর সদস্য-সংখ্যা ১৭ থেকে বেড়ে ১৮ হয়েছে। বিদায় নিয়েছেন প্রকাশ, বৃন্দা কারাট, মানিক সরকার, সুভাষিণী আলি, সূর্যকান্ত মিশ্র এবং জি রামকৃষ্ণন। প্রথম চার জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য করা হয়েছে। পলিটব্যুরোয় নতুন অন্তর্ভুক্তি হয়েছে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, জিতেন্দ্র চৌধুরী, কে বালকৃষ্ণন, ইউ বাসুকী, অমরা রাম, বিজু কৃষ্ণন, মরিয়ম ধওয়েলে ও অরুণ কুমার— এই ৮ জনের। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম অশোক ধওয়েলের স্ত্রী। সেই অর্থে প্রকাশ-বৃন্দার বিদায়ের পরে পলিটব্যুরোয় দেখা যাবে অন্য এক দম্পতিকে!
দলের শীর্ষ স্তরে মতের বিভাজন সামাল দিয়ে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেবির নাম প্রস্তাব করেছেন বঙ্গ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, সমর্থন করেছেন ধওয়েলে! আর পার্টি কংগ্রেসের কক্ষে এসে সেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন স্বয়ং বিজয়ন!
নতুন দায়িত্ব পেয়ে বেবি স্মরণ করেছেন প্রাক্তনদের। বলেছেন, ‘‘পলিটব্যুরোর ৭ সদস্যকে একসঙ্গে বিদায় দেওয়া কঠিন কাজ। দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সর্বস্তরে নতুন ও তরুণতর অংশকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’’ সেই সঙ্গেই তাঁর সংযোজন, ‘‘পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাওয়ার পরে সাধারণ সম্পাদককে হারানোর ধাক্কা প্রবল। এই ক্ষতি অপূরণীয়। এই পার্টি কংগ্রেসে প্রতি মুহূর্তে বোঝা গিয়েছে, প্রয়াত হয়েও সীতারাম আমাদের কত বড় শক্তির স্তম্ভ। আর মাঝের সময়টায় প্রকাশ কারাট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব সামলে দিয়েছেন, তাঁর অবদানও ভোলার নয়।’’ দলেরই কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ইয়েচুরির মৃত্যুর পরে কারাট আবার দলের রাশ হাতে নিতে চাইলে বাধা দেওয়ার কোনও পরিস্থিতিই সিপিএমে ছিল না। কিন্তু কারাট নীতিতে অটল থেকেছেন।
আর এক বিদায়ী নেত্রী বৃন্দার কথায়, ‘‘জাহাজে যেমন নোঙর থাকে, আমাদের ছিল সীতারাম। পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি নিতে নিতে সেই নোঙরটা হারিয়ে গিয়েছে। এই ক্ষতির পূরণ হয় না!’’
বিদায়ের হিসেব আর নতুনের পরীক্ষা নথিভুক্ত করেই ইতিহাস হল মাদুরাই পার্টি কংগ্রেস!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)