মাওবাদী হামলায় নিহত জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের। সোমবার জগদলপুরে। ছবি: পিটিআই।
ডাবল ক্রস! সর্ষের মধ্যে ভূত! ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুরে মাওবাদী হামলায় প্রায় দু’ডজন জওয়ানের মৃত্যুর পরে এমন সম্ভাবনাই ভেসে বেড়াচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অলিন্দে। হামলার ৪৮ ঘণ্টা পরে আজ ছত্তীসগঢ়ে পৌঁছান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বৈঠক করেন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে। কিন্তু গত দু’দিন ধরে রাজনৈতিক প্রচারে ব্যস্ত থাকা অমিত শাহ কেন এই ঘটনার নৈতিক দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেবেন না, আজ সেই প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
গত কয়েক দিন ধরেই গোয়েন্দা তথ্য আসছিল জাগারগুন্ডা-জোঙ্গাগুড়া তারেমে ঘাঁটি গেড়েছে প্রায় ১৫০-২০০ মাওবাদী। যাদের নেতৃত্বে রয়েছে বছর আটত্রিশের হিডমা। মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির তরুণতম সদস্য ও পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি-র ১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার। জঙ্গলের ভিতর থেকে আসা তথ্য ছিল প্রতি বারের মতো এ বারও জঙ্গলে পাতা ঝরার মরসুম শুরু হওয়ায় নিজেদের হারানো জমি উদ্ধারে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে মাওবাদীরা। ধারাবাহিক ভাবে আসা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার সকালে অভিযানে নামে সিআরপিএফ, কোবরা বাহিনী, ছত্তীসগঢ় পুলিশের ডিস্ট্রিক্ট রিজ়ার্ভ গার্ড।
কিন্তু অভিযানের গোটা পর্বটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, খুব সুকৌশলে ফাঁদ পেতেছিল মাওবাদীরা। মাওবাদীদের জমায়েতের কথা ছড়িয়ে দিয়ে আসলে জওয়ানদের জঙ্গলের গভীরে, নিজেদের এলাকায় টেনে আনাই মূলত লক্ষ্য ছিল মাওবাদীদের। যে সূত্রগুলির মাধ্যমে খবর এসেছিল তাঁরা পুলিশের সোর্স হিসাবে তথ্য জোগালেও, এ ক্ষেত্রে মাওবাদীদের পরিকল্পনামাফিকই জমায়েতের তথ্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মাডভি হিডমা
• বয়স বছর আটত্রিশ।
• বাড়ি ছত্তীসগঢ়ের সুকমায় পূর্বতী গ্রামে। সে গ্রামে এখনও অভিযান চালাতে পারেনি বাহিনী।
• ইংরেজি ও বিভিন্ন জনজাতি ভাষায় দক্ষ। বিদেশে জঙ্গি কার্যকলাপে প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে দাবি গোয়েন্দাদের একাংশের।
• মাওবাদীদের ‘পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি’-র ১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার। কেন্দ্রীয় কমিটির তরুণতম সদস্য।
• জিরাম ঘাটিতে কংগ্রেস নেতাদের উপরে হামলা, বিধায়ক ভীমা মান্ডবীর হত্যা-সহ নানা মামলায় অভিযুক্ত।
ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী হামলার খতিয়ান
২০১৫
• হামলার ঘটনা: ৪৬৬
• জওয়ানের মৃত্যু: ১০১
২০১৬
• হামলার ঘটনা: ৩৯৫
• জওয়ানের মৃত্যু: ১০৭
২০১৭
• হামলার ঘটনা: ৩৭৩
• জওয়ানের মৃত্যু: ১৩০
২০১৮
• হামলার ঘটনা: ৩৯২
• জওয়ানের মৃত্যু: ১৫৩
২০১৯, ৩১ মে পর্যন্ত
• হামলার ঘটনা: ১২৯
• জওয়ানের মৃত্যু: ৩৬
সূত্র: সংসদে দেওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য
প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, মাওবাদীদের অতর্কিত হামলার সময় জওয়ানরা একেবারেই প্রস্তুত অবস্থায় ছিলেন না। রীতিমতো আটঘাট বেঁধে জঙ্গলে নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে জওয়ানদের জন্য অপেক্ষায় ছিল মাওবাদীরা। বিশেষ করে জঙ্গল যুদ্ধে অভ্যস্ত কোবরা কমান্ডো জওয়ানের মৃত্যুর সংখ্যা দেখে মনে করা হচ্ছে, বাহিনীর একটি বড় অংশ অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রায় চারশো মাওবাদীর বন্দুকের নিশানায় চলে এসেছিল। ঠিক কত জন মাওবাদী সেখানে জড়ো হয়েছে সে বিষয়েও বাহিনীর কাছে স্পষ্ট তথ্য ছিল না।
প্রাথমিক আক্রমণের অভিঘাত সামলিয়ে পাল্টা হামলা চালালে মাওবাদীদের প্রায় ১৫-২০ জনের মৃত্যু হয় বলে দাবি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। যদিও অধিকাংশ মৃত সঙ্গীর দেহ সংঘর্ষস্থল থেকে মাওবাদীরা নিয়ে যেতে সক্ষম হওয়ায় ঠিক কত জন মাওবাদী মারা গিয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে এখনও জানাতে পারেনি কেন্দ্র। তবে মাওবাদীদের পক্ষ থেকে আজ দাবি করা হয়েছে, নিখোঁজ জম্মুর বাসিন্দা সিআরপিএফ জওয়ান রাকেশ্বর সিংহ মনহাস তাদের হাতে বন্দি রয়েছেন। সুস্থ রয়েছেন তিনি। বিষয়টি জানার পরেই আজ জওয়ানের স্ত্রী মীনু মনহাস প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর স্বামীকে মুক্ত করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। সূত্রের মতে, ওই জওয়ানকে মুক্ত করার জন্য মাওবাদীদের সঙ্গে দর কষাকষি শুরু হয়েছে।
হামলার নিন্দা করে ক্ষয়ক্ষতির পিছনে গোয়েন্দা ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী। তিনি বলেন, ‘‘এক জন মাওবাদী পিছু এক জন করে জওয়ান মারা গিয়েছেন। গোয়েন্দা ব্যর্থতা না-হলে এত ক্ষয়ক্ষতি হয় না। গোটাটাই আসলে অদক্ষ ভাবে চালানো একটি অভিযান।’’ যদিও গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিআরপি-র ডিজি কুলদীপ সিংহ। তাঁর দাবি, ‘‘গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ বা অভিযান সংক্রান্ত পরিকল্পনায় কোনও ব্যর্থতা ছিল না।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা হলে আমাদের আরও জওয়ান মারা যেতেন। ওই এলাকাটি মাওবাদীদের কব্জায়। ফলে স্বভাবতই ‘ট্যাকটিক্যাল অ্যাডভান্টেজ’ ছিল মাওবাদীদের।’’ সূত্রের মতে, মাওবাদীরা পিছন থেকে লাইট মেশিনগান দিয়ে হামলা চালানোয় ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়। কিন্তু রাহুল গাঁধীর প্রশ্ন, একুশ শতকে দাঁড়িয়ে অভিযানে যাওয়া বাহিনীর শরীরে কেন বুলেট প্রুফ ভেস্ট থাকবে না? কেন আহতদের উদ্ধার করতে এত দেরি হবে? নীরব সব পক্ষই।
গোটা ঘটনায় আতসকাচের নীচে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকাও। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা এ দিন বলেন, ‘‘অন্য যে কোনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে এত ক্ষণে ইস্তফা দিতেন। ৩ এপ্রিল সকালে এগারোটায় হামলা হল। পরের চব্বিশ ঘণ্টা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নীরব। উল্টে সে সময়ে তাঁকে তামিলনাড়ুতে এক প্রাক্তন অভিনেত্রীর হয়ে ভোট প্রচার করতে দেখা গিয়েছে। তার পর তিনি ভোট প্রচারে কেরল যান। পরবর্তী গন্তব্য ভোটমুখী অসম। হামলার চব্বিশ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও পরের দিন সকালে অসমে একটি জনসভা করেন তিনি। তার পরে অমিত শাহের টনক নড়ে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এতটা গা-ছাড়া মনোভাব নিলে চলে?’’ ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলা চলাকালীন একাধিক বার পোশাক পাল্টানোর কারণে পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল তৎকালীন ইউপিএ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাটিলকে। সেই ঘটনার উল্লেখ করে সুরজেওয়ালার প্রশ্ন, ‘‘কি করে এক জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতটা অসংবেদনশীল হতে পারেন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy