Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

ভেঁপু বাজিয়ে আম্মার জন্য সিংহাসন আনত পেয়াদা

প্রধানমন্ত্রী তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী। গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন প্রধান শ্যামল দত্তকে প্রধানমন্ত্রী পাঠিয়েছিলেন জয়ললিতার সঙ্গে দেখা করতে।

বহু পরিচিত দৃশ্য।— ফাইল চিত্র।

বহু পরিচিত দৃশ্য।— ফাইল চিত্র।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৪
Share: Save:

প্রধানমন্ত্রী তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী। গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন প্রধান শ্যামল দত্তকে প্রধানমন্ত্রী পাঠিয়েছিলেন জয়ললিতার সঙ্গে দেখা করতে। তামিলনাড়ুতে নাশকতার সম্ভাবনা, জয়ার নিরাপত্তা— এ সব ছিল আলোচনার বিষয়। শ্যামলবাবুর সঙ্গে আরও কিছু কেন্দ্রীয় অফিসার ছিলেন। রাজ্যের অফিসাররাও এসেছিলেন।

শ্যামলবাবু আগে সে ভাবে জয়াকে একান্তে দেখেননি। সে ছিল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এক বিশাল হলঘরে কোনও চেয়ার-টেবিল নেই। এক দিকে রাজ্যের অফিসাররা দাঁড়িয়ে। আর এক দিকে কেন্দ্রের অফিসাররা। অনেকক্ষণ পর একটা ভেঁপু বেজে উঠল। ৪ জন পেয়াদা একটা লাল সিংহাসন নিয়ে প্রবেশ করলেন। পেয়াদাদের সাদা পোশাক, সঙ্গে লাল টুপি, বুকের কাছে সোনালি ধাতব আভরণ। আবার প্রতীক্ষা। আবার ভেঁপুর ধ্বনি। এ বারে সিল্ক শাড়ি পরিহিতা জয়ললিতার প্রবেশ। ধীর লয়ে আসন গ্রহণ। এবং তৎক্ষণাৎ রাজ্য অফিসারদের সাষ্টাঙ্গ প্রণাম। উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের গর্বে গর্বিত কলকাতার বাঙালি শ্যামল দত্ত তখন একেবারে থতমত।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তা এই গল্পটি শুনিয়ে বললেন, কেন্দ্রের অফিসাররা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেননি বটে, কিন্তু কিছুটা জাপানি কায়দায় ওঁরাও তখন অনেকটা অবনত হয়ে প্রণাম জানান। তখনকার মতো টেবিল-চেয়ার হীন হলঘরেই আলোচনাটা চলল অনেকক্ষণ ধরে।

জয়ার জীবনে এ সব ‘ফিল্মি ড্রামা’র অভাব ছিল না। যতই এমজিআর-এর আশীর্বাদধন্য হোন, দ্রাবিড় রাজনীতিতে এত দিন কর্তৃত্ব ধরে রাখা চারটিখানি কথা নয়। বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর মতো সমালোচকও সেটা স্বীকার করেন। তাঁর মতে, রক্ষণশীল তামিল সমাজে ফিল্ম থেকে উঠে আসা এ হেন সেলিব্রিটির গ্রহণীয় হয়ে ওঠা প্রায় অলৌকিক ঘটনা। স্বামীই বললেন, জয়াও অলৌকিকে বিশ্বাস করতেন। নানা ধরনের তান্ত্রিক আসত তাঁর পোয়েজ গার্ডেনের বাসভবনে। প্রতিপক্ষকে বিনাশ করা, প্রেতাত্মা দূর করায় তান্ত্রিক পুজোআচ্চা ছিল তাঁর অবসর বিনোদন।

প্রথম জীবনে সংবাদমাধ্যম জয়ার পক্ষেই ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে তারা হয়ে ওঠে জয়ার চক্ষুশূল। ১৯৯২ সালে কুম্বকোনমে মহামাতাম মন্দিরের কুণ্ডে পুণ্যস্নানে গিয়েছিলেন জয়ললিতা। সেদিন বিশেষ পুজোর দিন। প্রচুর ভিড়ের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বেষ্টনী— পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ৪৮ জন তীর্থযাত্রী চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে মারা যান। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, জয়ললিতার জেড প্লাস নিরাপত্তার জন্য সাধারণ মানুষের দেখভালে কেউ ছিল না। বুলেটপ্রুফ কাঁচের স্নানঘর তৈরি হয়েছিল জয়ার জন্য। মন্দিরের চেয়েও সেটি দেখতেই ভিড় নাকি হয়েছিল বেশি। এই প্রচারে জয়ললিতা খেপে যান। সংবাদমাধ্যমের উপর সে সময় খুবই খড়্গহস্ত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে বিপদ বাড়ে। পরবর্তী কালে সেটি তিনি বুঝতে পারেন এবং সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ঝগড়া মেটানোর চেষ্টা করেন।

তবে জয়ললিতা এমনিতে পুরনো রাগ ভুলতেন না। তাঁর বিরুদ্ধে তানসি জমি কেলেঙ্কারি নিয়ে মামলা করেছিলেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। তখন জয়া নাকি রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে দলে বলেছিলেন, তোমাদের এই ধুতি পরা লোকগুলোর মধ্যে একজনও নেই যে ওই স্বামী নামক লোকটিকে শিক্ষা দিতে পারে? তার পরেই এডিএমকে-র কর্মীরা স্বামীকে পিটিয়েছিল। আরও আছে। ১৯৯৪ সালে এডিএমকে বিল এনেছিল, যাতে ৬৯ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথা ছিল। কে এম বিজয়ন নামে চেন্নাইয়ের এক আইনজীবী তার প্রতিবাদে আদালতে যাওয়ায় তাঁকে এমন পেটানো হয় যে, বেশ কয়েক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

বিপুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি দুর্নীতির অভিযোগ আর সামন্ততান্ত্রিক বিলাসিতা জয়াকে কোনও দিন ছেড়ে যায়নি। বান্ধবী শশিকলার ভাইপো সুধাকরণকে দত্তক নিলেন। আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণ সমাজের প্রতিবাদে পরোয়া না করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিবাজি গণেশনের নাতনি সত্যলক্ষ্মীর সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন।

জীবনীকার বাসন্তী জানাচ্ছেন, সবাই ‘আম্মা’ বলে ঠিকই। আসলে জয়া মেজাজে পুরোপুরি ‘ম্যাডাম চিফ মিনিস্টার’। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম কর্মীরা সল্টলেকে জ্যোতি বসুর বাড়ি গিয়ে জ্যোতিদা বলে ডাকতেন না, তেমনই জয়ার বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সাহস কর্মীদের হতো না। আডবাণী তখন উপপ্রধানমন্ত্রী, জয়ললিতার সমস্ত সাংসদকে প্রাতরাশের বৈঠকে ডেকেছিলেন। সাংসদেরা কী খাবেন, ঠিক করে দিয়েছিলেন জয়ললিতা। মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে সেই মেনু আগাম পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

চুম্বকের মতো আকর্ষণ ছিল জয়ললিতার। স্বৈরতন্ত্রী, তবু অগুন্তি মানুষ তাঁর অনুগত হতে ভালোবাসত। ভারতীয় রাজনীতি সেই রঙিন আর রহস্যময়ী আইকনকে হারাল এ বার।

অন্য বিষয়গুলি:

Jayalalithaa central officers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy