বিবর্ণ: কাঁটাতারের ও-পারে শুকিয়ে যাচ্ছে চাঁদ সিংহের খেত। —নিজস্ব চিত্র।
দিল্লিতে বসে রণহুঙ্কার দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী আর পঞ্জাবের হুসেনিওয়ালা সীমান্তে কপাল চাপড়াচ্ছেন চাঁদ সিংহ।
সীমান্তে যুদ্ধের হুঙ্কার আর ওয়াঘা-অটারীর প্রাত্যহিক কুচকাওয়াজের চোখরাঙানি যত বেড়েছে, প্রতিটি দিন ততই একটু একটু করে দেনার দায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছেন বছর বাষট্টির চাঁদ। সব মিলিয়ে প্রায় পনেরো দিন পরে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে, তত ক্ষণে শীতের ফসল ‘গেঁহু’-র অর্ধেক শুকিয়ে গিয়েছে খেতেই। প্রয়োজনের জলটুকুও জোগাতে পারেননি চাঁদ।
সীমান্ত বরাবর কাঁটাতারের বেড়া আটকে দিয়েছে তাঁর জমির পথ। নিজের জমি, নিজের ফসল। অথচ দরকারে-অদরকারে সেই ফসলের তদারকিতে যেতে পারেন না চাঁদ। যাবেনই বা কী করে! পুলওয়ামা-বালাকোট ঘিরে উত্তেজনার আবহে কাঁটাতারের ফটক খোলার ঝুঁকি নেয়নি সীমান্তরক্ষী বাহিনী। বেড়ার মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে বিদ্যুতের প্যাঁচানো ‘কোবরা’ তার। কয়েক হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎবাহী সেই তার ছুঁলে ঝলসে ছাই হয়ে যাওয়া নাকি নিমেষের ব্যাপার।
পাকিস্তানের বালাকোটের জঙ্গি শিবিরে বায়ুসেনার অভিযানের পরেই চূড়ান্ত সতর্কতা জারি হয় পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে। পঞ্জাবের ৫৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে বিএসএফের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় সেনাও। ফিরোজপুর, গুরদাসপুর, পঠানকোট, ফাজ়িলকা-র পাক সীমান্ত বরাবর শুরু হয় প্রবল তৎপরতা। এ-পারে, ও-পারেও।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ফিরোজপুরের হুসেনিওয়ালা এলাকার সীমান্ত-ঘেঁষা গ্রাম উল্লুক। ঠিকই পড়ছেন, উল্লুক। ভারতের আর পাঁচটা সীমান্তের মতোই এখানে পাহারার দায়িত্বে থাকে বিএসএফ। গ্রাম থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে পাকিস্তান। খালি চোখেই দেখা যায়, বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছে পাক রেঞ্জার্স। টানা কাঁটাতারের বেড়া চলে গিয়েছে এক দিকে রাজস্থান, অন্য দিকে জম্মু পর্যন্ত। ওই বেড়া পার হয়ে আরও দেড়শো মিটার গেলে দেখা যাবে, শস্যখেতের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে শক্ত প্লাস্টিকের মোটা দড়ি। এখানে সেটাকেই মেনে নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে।
দেশভাগের সময়ে দিল্লিতে বসেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত বেঁধে দিতে মানচিত্রে অলীক লাইন টেনেছিলেন সিরিল জন র্যাডক্লিফ। সেই লাইনই আজ চরম দুর্দশা ডেকে এনেছে চাঁদদের জীবনে। ওই গণ্ডির জন্যই চাঁদের পাঁচ কাঠা জমি এখন ভারত সরকারের সীমান্তে লাগানো কাঁটাতারের বাইরে। কার্যত ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’। নিয়ম অনুযায়ী, প্রকৃত সীমান্তরেখা থেকে দু’দিকে কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত দেড়শো মিটার করে জমি দু’দেশেরই ছেড়ে রাখার কথা। সেখানেই পড়ে গিয়েছে চাঁদের জমি। তাঁর বছরভর আয়ের উৎস। ওই জমিতে যাওয়ার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু লোহার ফটক। সমস্যা হল, চাইলেই সেখানে যেতে পারেন না চাঁদরা। পরিচয়পত্র দেখানো আছে, আরও হাজারো নিয়ম আছে। এ পারে তা-ও কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। ও-পারে প্লাস্টিকের দড়ির দেড়শো মিটার পরে কোনও বেড়াই দেয়নি পাকিস্তান। ফলে জায়গাটা মাদক পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য। সেই কারণেই চোরাচালান, অনুপ্রবেশ রুখতে গেট বন্ধ করে রাখে বিএসএফ।
বছরে দু’বার চাষ করেন চাঁদ। বর্ষার সময়ে ধান। শীতের সময়ে গম। নভেম্বরে গম পুঁতেছিলেন। এপ্রিলের শেষে সেই ফসল কেটে নেওয়ার কথা ছিল। পারেননি। কারণটা আগেই লিখেছি। প্রথমে পুলওয়ামা ও পরে বালাকোট পাল্টে দিয়েছিল চাঁদদের জীবন। যুদ্ধের আশঙ্কায় সীমান্ত জুড়ে বিএসএফের পাশাপাশি ‘ফরোয়ার্ড’ অবস্থানে চলে এসেছিল ভারতীয় সেনা। একই ভাবে তৎপর হয়েছিল পাক সেনাও। চাঁদের কথায়, ‘‘গ্রাম থেকেই পাকিস্তানের ট্যাঙ্ক চোখে পড়ছিল।’’ সেই সময়ে ভারতীয় চাষিদের নিরাপত্তার জন্যই কাঁটাতারের বেড়ার দরজা পেরিয়ে পাকিস্তান-ঘেঁষা খোলা খেতে গিয়ে তাঁদের চাষ করার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিএসএফ। চাষ বন্ধ থাকে বেশ কিছু দিন। বিএসএফের দাবি, সেটা দুই থেকে তিন দিন। যদিও চাঁদ সিংহের মতে, প্রায় দু’সপ্তাহ। ওই সময়ে জল দিতে না-পারায় ফসল শুকিয়ে যায় মাঠেই।
সবুজ ফসল রোজ একটু একটু করে হলুদ হয়েছে, আর বন্ধ ফটকের সামনে বসে হাহুতাশ করেছেন চাঁদ। ফটক খোলেনি। চাঁদের প্রশ্ন, ওই যুদ্ধ-যুদ্ধ করার কি খুব দরকার ছিল? ফসল নষ্ট হওয়ার পরে মহাজনের থেকে ধার নেওয়া টাকা কী ভাবে শোধ দেবেন, জানেন না তিনি। চাঁদের স্পষ্ট কথা, “আমি কেন, গোটা গ্রাম এ বার যুদ্ধবাজদের ভোট দেবে না বলে ঠিক করেছে।” ওই জমিগুলোতে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ করে কাঠা-পিছু ৩০০-৪০০ টাকা রোজ আয় হত মতি সিংহের। যুদ্ধের আবহাওয়ায় রোজগার হারিয়েছেন তিনিও। দু’জনেই বলছেন, যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ হলে সবার আগে পেটে লাঠি পড়ে চাষিদেরই। তাঁরা যেমন জমিতে যেতে পারেননি, তেমনই পাক চাষিরাও আসতে পারেনি নিজেদের খেতের কাজে। মতি জানিয়ে দিলেন, তাঁদের কেন্দ্রে প্রার্থী এখনও ঠিক হয়নি।
কিন্তু তিনি যে-ই হন, গ্রামের ভোট কংগ্রেসই পাবে।
সমস্যা রয়েছে আরও। সকালে বেড়া পেরিয়ে চাষের জমি দেখভাল করে বিকেলে ফিরে আসার যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী, তা যথেষ্ট নয় বলে বহু দিন ধরেই অভিযোগ জানিয়ে আসছেন কৃষকেরা। তল্লাশির বাড়াবাড়ি নিয়েও অভিযোগ বিস্তর। বিএসএফের বক্তব্য, সীমান্ত যেখানে এত কাছে, মাদকের চোরাকারবারিরা যেখানে প্রতি মুহূর্তে তৎপর, সেখানে নিয়মকানুন ও তল্লাশিতে ঢিলে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। সীমান্ত-ঘেঁষা গ্রাম হওয়ায় রাতবিরেতে কোথাও যেতে হলেও সমস্যা পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। সীমান্তের ফাঁড়িতে দাঁড়িয়ে বিএসএফ কর্তারা যুক্তি দেন, “গ্রামবাসীদের ভালমন্দের দায় আমাদের। উত্তেজনার সময়ে পাক রেঞ্জার্স কিছু করে বসলে তার দায়ও চাপবে আমাদের ঘাড়ে। তাই কোনও ঝুঁকি নেওয়া যায় না।”
সীমান্তে চরম উত্তেজনার আঁচ প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছে জীবনকে। যুদ্ধের নাম শুনলে আঁতকে ওঠেন চাঁদ-মতিরা। যে সার সত্য চাঁদরা বুঝতে পেরেছেন, তা দিল্লি বুঝেছে কি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy