মাকড়ি গ্রামে এ ভাবেই পড়ে আছে অসম্পূর্ণ বহু বাঙ্কার। নিজস্ব চিত্র
গোলাগুলির আওয়াজ অনেক শুনেছে মাকড়ি। রোজই শোনে। কিন্তু আকাশে আগুনের গোলা ফাটতে দেখার অভিজ্ঞতাটা ছিল একেবারে নতুন।
জম্মুর নৌশেরার নিয়ন্ত্রণরেখা লাগোয়া মাকড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের হুবহু মনে আছে দিনটার কথা। ২৭ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের দিক থেকে সে দিন মর্টার পড়েনি নিয়মমাফিক। আগের ভোরের বালাকোট অভিযানের পরে এক ব্যতিক্রমী সকাল।
ভুল ভাঙে সকাল ৯টায়। মাকড়ির বাসিন্দা বিজয় শর্মা বলছিলেন, ‘‘হঠাৎ আকাশে প্রবল বিস্ফোরণ। আগুনের গোলা। তার পরেই দেখি বিমান ভেঙে পড়েছে। আকাশে ভাসছে প্যারাসুট। বাতাসের অভিমুখ পাকিস্তানের দিকে থাকায় ও-দিকেই ভেসে যাচ্ছে প্যারাসুটটা। পরে জেনেছি, ওই প্যারাসুট উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের।’’ পাকিস্তানের তিনটে যুদ্ধবিমান শ্রীনগরের রেডারে ধরা পড়তেই উড়ে গিয়েছিল অভিনন্দনের মিগ-২১। তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে নৌশেরার আকাশে চলে এসেছিলেন অভিনন্দন। পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানকে ঘায়েল করলেও নিজের বিমান ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বিজয়ের আক্ষেপ যাচ্ছে না। বলছেন, ‘‘নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে মাত্র ৭০০-৮০০ মিটার দূরে পড়েছিলেন অভিনন্দন। আর একটু হলে ভারতের এলাকাতেই থেকে যেতেন।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
রাজৌরি থেকে নিয়ন্ত্রণরেখাকে ডান পাশে সমান্তরালে রেখে নৌশেরার লাম হয়ে পৌঁছেছিলাম মাকড়িতে। রাস্তার দু’পাশে পাক গোলা ও স্প্লিন্টারের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া বাড়ির সারি। এক সময়ে ভিতরে প্রাণের উপস্থিতি ছিল। এখন পোড়ো। ঝলসানো জানলা, ভেঙে পড়া ছাদ। চলার পথেই কানে আসছিল গুম গুম শব্দ। দেখা যাচ্ছিল সাদা ধোঁয়াও। পরে জেনেছি, সকাল থেকেই গোটা এলাকাটাকে নিশানা বানিয়ে ‘শেলিং’ চালিয়েছে পাক সেনা।
রোজকার শেলিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন বিজয়। আওয়াজ শুনলেই ঢুকে পড়েন সরকারের বানানো বাঙ্কারে। কিন্তু সকলের সেই সুযোগ হয় কোথায়! লাল হুসেন নামে এক বৃদ্ধ থাকতেন এই গ্রামে। এক দিন তাঁর বাড়িতে এসেছিল বছর আটেকের নাতনি তবসুম। হঠাৎ শুরু হয় গোলাবৃষ্টি। বাঙ্কার ছিল না কাছেপিঠে। তাই বাড়ির সকলে আশ্রয় নিয়েছিলেন বিভিন্ন ঘরে। লালের সঙ্গে তবসুম যে ঘরে লুকিয়েছিল, সেখানেই এসে পড়ে গোলা। দাদু-নাতনি কেউই বাঁচেননি। পরিবারের আফসোস, সরকার বাঙ্কার করে দিলে হয়তো বাঁচতেন।
জম্মুর নিয়ন্ত্রণরেখা লাগোয়া সব গ্রামেরই কম-বেশি সমস্যা এই বাঙ্কার। ২০১৪-য় বিজেপি বলেছিল, কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে পরিবার-পিছু বাঙ্কার তো বটেই, প্রতিটা গ্রামে ‘কমিউনিটি বাঙ্কার’ও গড়ে দেবে তারা। বিরোধীদের অভিযোগ, আর পাঁচটা প্রতিশ্রুতির মতো এটাও ছিল মোদী সরকারের ‘জুমলা’। মাকড়ি গ্রামে কোথাও দেখা গেল, বাঙ্কারের কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু পুরো টাকা না-মেলায় ভিতরে ঢোকার সিঁড়িটাই না-বানিয়ে চলে গিয়েছে ঠিকাদার। কোথাও বাঙ্কারের দেওয়াল আছে, কিন্তু ছাদ নেই। প্রাণ বাঁচানোর বাঙ্কার তাই এখন আবর্জনা ফেলার গর্ত। গ্রামবাসীরাই বললেন, সরকার-নির্ধারিত দরে বাঙ্কার তৈরিতে রাজি হয়নি ঠিকাদার সংস্থা। তাই মাঝপথে তারা চলে গিয়েছে কাজ ফেলে। বাঙ্কার নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রের উপরে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয় মানুষের।
এর পরেও দিল্লিতে ফের মোদী সরকারকে দেখতে চাইছেন মাকড়ির বিজয়, এমনকি প্রবীণদের অনেকেও। তাঁদের যুক্তি, ‘‘কংগ্রেসি আমলেও পাকিস্তানের দিক থেকে গোলা পড়ত। কিন্তু তখন আমরা চুপ করে থাকতাম। এ জমানায় অন্তত পাল্টা হামলা করার সাহস দেখাচ্ছে সরকার।’’ জাতীয়তাবাদের আবেগে তাই জম্মু ও উধমপুরের দু’টি আসনেই জয় নিশ্চিত বলে ধরে রেখেছে রাজ্য বিজেপি। নৌশেরার বিজেপি বিধায়ক রবীন্দ্র রায়না বলছেন, ‘‘স্থানীয় হিন্দু ভোট সব বিজেপির পক্ষে যাবে। আমার কেন্দ্র এগিয়ে দেবে জম্মুর বিজেপি প্রার্থী যুগলকিশোর রায়নাকে।’’
মাকড়ির শেষ প্রান্তে যেতে চাওয়ায় বাধা দিলেন গ্রামের মুখে থানা গেড়ে বসে থাকা জাঠ রাইফেলসের জওয়ানেরা। জানালেন, সকালেও গোলা পড়েছে। প্রাণের ঝুঁকি আছে। মর্টার ছাড়াও ভয় রয়েছে আইইডি-র। কার্যত উন্মুক্ত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে পাক হানাদারদের আইইডি পুঁতে দিয়ে যাওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে অতীতে। প্রায়শই সেনা জিপ লক্ষ্য করে হামলা চালায় পাক স্নাইপারেরা।
এরই নাম দিনযাপন। সেনা ক্যান্টিনে সস্তায় জিনিস কিনতে এসেছিলেন মাকড়ির যুবক রাকেশ। বললেন, ‘‘জানি, নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। কিন্তু যাব কোথায়? এখানেই থাকতে হবে। একমাত্র দু’দেশের মধ্যে শান্তি এলে তবেই প্রাণের ভয় দূরে সরিয়ে রেখে বাঁচতে পারব।’’ কিন্তু মাকড়িতে তো জাতীয়তাবাদেরই প্রবল হাওয়া! বাঙ্কারের অভাবে প্রাণ যাচ্ছে, অথচ ‘জবাব’ পৌঁছচ্ছে বলে তৃপ্ত গ্রামবাসীরাই। তা হলে শান্তির পায়রা উড়বে?
এ বার প্রায় ফিসফিসিয়ে রাকেশ বলে গেলেন, ‘‘অচ্ছে দিন অনেক দূর।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy