মনোজকুমার প্রধান
দাঙ্গার দশ-এগারো বছর পরেও কন্ধমালের খ্রিস্টানদের মনে কীসের এত ভয়, বুঝে উঠতে পারেন না বালকৃষ্ণ জুন্ডি।
জেলা সদর ফুলবানি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ছোট গঞ্জ ফিরিঙ্গিয়া। ধুলো ওড়া বাজার। জামাকাপড়, খেলনার দোকান, ভাতের হোটেল। ছোটখাটো একটা হাসপাতাল। সবই কেমন মলিন। বিবর্ণ। এ হেন জনপদের দাপুটে বিজেপি নেতা বালকৃষ্ণ বলছেন, “গোটা জেলার কোথায়ওই এখন আর কোনও সমস্যা নেই। হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সবাই মিলেমিশে আছি। আর তা ছাড়া, আমাদের এখানে তো ২০০৮-এও কোনও গোলমাল হয়নি।”
অথচ বালিগুড়ায় খ্রিস্টানদের চোখেমুখে যে আতঙ্কের ছবি দেখে এসেছি, ফিরিঙ্গিয়াতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। গলার স্বর নামিয়ে তাঁরা বলছেন, ২০০৮-এর আগস্টে তাণ্ডব হয়েছিল বইকি। ঘর পুড়েছিল। কত লোক পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ত্রাণ শিবিরে। যারা গোলমাল পাকিয়েছিল, তারা কি সঙ্ঘের লোকজন? আচমকা তালা পড়ে যায় মুখে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বালকৃষ্ণের দাবি, বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবার তাণ্ডবের ত্রিসীমানায় ছিল না। “ও সব বিজেডি আর কংগ্রেসের রাজনৈতিক রেষারেষির ফল। খ্রিস্টানদের সঙ্গে আমাদের কোনও সংঘাত নেই। এই তো ডিমরিগুড়ার খ্রিস্টানরা ভোটে আমাদের হয়ে খাটছেন।” সুর অবশ্য পাল্টাল একটু পরেই। “সমস্যাটা কোথায় জানেন। ওরা গরিব মানুষদের লোভ দেখিয়ে ধর্ম বদল করছে। কিন্তু তার জন্য যে নিয়মকানুন, তা মানছে না। ধর্ম বদলের পরে আদিবাসীরা দেখছে, তারা আর তফসিলি হওয়ার সুবিধা পাচ্ছে না। তখনই গোলমাল বাধছে।” কন্ধমালে ‘ঘর ওয়াপসি’র ধারেকাছে নেই সঙ্ঘ পরিবার, দাবি বালকৃষ্ণের।
দাঙ্গাকারীর তালিকায় সবচেয়ে বড় নামটাই অবশ্য বিজেপির ঘরের লোক। মনোজকুমার প্রধান। পুলিশের খাতায় তাঁর পরিচিতি ‘ফিল্ড কমান্ডার’। উন্মত্ত জনতাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে। তাঁর নামে ১৪টা মামলা। একটা খুনের মামলায় ৭ বছর সাজা পেয়েছেন। আর একটিতে ৬ বছর। তবে বছরখানেক জেলে কাটিয়েই তিনি আপাতত জামিনে মুক্ত। মনোজ ধরা পড়েন ২০০৮-এর ১৫ অক্টোবর। সংঘর্ষে আহত হয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন ব্রহ্মপুরের একটি লজে। কন্ধমালের খ্রিস্টানরা বলছেন, মনোজ ধরা পড়তেই থিতিয়ে যায় গোলমাল।
জেলে থাকা অবস্থাতেই ২০০৯-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপির টিকিট পেলেন মনোজ। লড়লেন জেলার জি-উদয়গিরি কেন্দ্র থেকে এবং জিতলেন প্রায় ২৪ হাজার ভোটে। সে বার গোটা রাজ্যের ১৪৭টি আসনের মধ্যে মাত্র ৬টি পেয়েছিল বিজেপি। তার মধ্যে কন্ধমালেই দু’টো। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে ২০১৪-য় অবশ্য মনোজকে আর টিকিট দেয়নি বিজেপি। আর কংগ্রেস ফের জিতে নিয়েছে আসনটা।
মনোজ প্রধানদের কাণ্ডকারখানা পিছনে ফেলে সামনে এগনো যে দরকার তা মানেন কন্ধমালের বেশির ভাগ মানুষই। কিন্তু রাজনীতি তা হতে দেয় কই! দাঙ্গা বন্ধে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন ডালিবাড়ি গ্রামের আদিবাসী নেতা শশীভূষণ প্রধান। সে কথা স্বীকার করেন এলাকার খ্রিস্টানরাও। তাঁরা কথায়, “বাইরে থেকে লোকেরা এসে উস্কানি দেয়। দাঙ্গার সময় খুবই দিয়েছিল। এখনও চেষ্টা চালায়।”
কারণ, ধর্মের কথা বলে যত সহজে ভোটে ফায়দা তোলা যায়, উন্নয়ন দিয়ে তত সহজে হয় না। ফিরিঙ্গিয়ায় সরকারি কলেজ নেই। বেসরকারি কলেজে খরচ বিস্তর। হাসপাতাল একটা আছে বটে, কিন্তু চিকিৎসক নেই, পরিকাঠামোও নেই। অ্যাম্বুল্যান্সটা পর্যন্ত ডাকতে হয় ১০ কিলোমিটার দূর থেকে। দেশের অন্যতম দরিদ্র জেলা কন্ধমাল থেকে দলে দলে যুবক-তরুণরা অন্যত্র যান দাদন খাটতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা আর রাস্তাঘাটের উন্নতি— ফিরিঙ্গিয়ার এই তিন মূল চাহিদার দিকেই রাজ্য সরকার নজর দেয়নি, অভিযোগ বালকৃষ্ণের। তার বদলে বাজারের পাশেই বিরাট মন্দির গড়েছেন ফুলবানির প্রাক্তন বিজেডি বিধায়ক তথা মন্ত্রী পদ্মনাভ বেহরা। ভিন্ রাজ্যের সাংবাদিককে মহা উৎসাহে সেই মন্দির দেখাতে নিয়ে চললেন বিজেপি নেতার ছায়াসঙ্গী সুধাংশু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy