মানা ক্যাম্পে বাঙালি ক্লাবে মেয়েদের প্রশিক্ষণ। নিজস্ব চিত্র।
দুর্গাপুজোর স্থায়ী মণ্ডপের সামনেই নাটক-গান-বাজনার বাঁধানো মঞ্চ। তার দেওয়ালে হাতে আঁকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভরদুপুরে চলন্ত গাড়ি থেকে ভোটের প্রচারের সঙ্গেই হরিসভা থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসছে। দোকানের সাইনবোর্ডে হিন্দি হরফে বাংলা শব্দ। রাস্তার মোড়ে রসগোল্লার জন্য বিখ্যাত সাধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে শিঙাড়ার লেচি বেলা হচ্ছে।
নেতাজি ক্লাবের ভিতরে মেয়েদের সেলাই শেখানোর ক্লাস চলছে। ক্লাবের সামনে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি। কাকের উৎপাতেই হবে হয়তো, মূর্তির চশমাটা এক দিকে বেঁকে গিয়েছিল। ছবি তোলার উপক্রম করতেই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, বছর সাতচল্লিশের মলয়কান্তি মধু তাড়াতাড়ি চটি খুলে মূর্তির বেদিতে উঠে পরম মমতায় চশমাটা ঠিক করে দেন। নেমে বলেন, ‘‘এই মানুষগুলোর জন্যই বাঙালিকে এখনও লোকে চেনে।’’
পরিচিতির সঙ্কট! রায়পুরের মানা ক্যাম্পে বাঙালির রোজকার লড়াই এক কথায় সেই রকমই।
সালটা ১৯৬৪। পূর্ব পাকিস্তানের ভিটেমাটি ছেড়ে মানুষ এ পারে আসতে শুরু করলেন। তাঁদের দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হল। তখনও মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তীসগঢ় হয়নি। পাকাপাকি ভাবে দণ্ডকারণ্যে যাওয়ার আগে প্রথম ঠিকানা ছিল মানা ট্রানজিট ক্যাম্প। পুরনো সেনার ছাউনির ঘরেই ঠাঁই মিলল ভিটেমাটি ছেড়ে আসা বাঙালিদের। সেখান থেকে কেউ কাঙ্কেরের পখানজোড়, কেউ বস্তারের অন্য কোথাও। অনেকে থেকে গেলেন এই রায়পুরের মানা ক্যাম্পেই। মলয়কান্তি বলছিলেন, ‘‘মানা ক্যাম্পে এখন প্রায় ৮ হাজার ভোটার। আগে সবই বাঙালি ছিল। এখন অনেক অবাঙালি পরিবারও রয়েছে।’’
লোকসভা ভোটে মানা ক্যাম্প থেকে ছত্তীসগঢ় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা এ বার পরিচিতির লড়াই লড়ছেন। তাঁদের দাবি, বাঙালি নমঃশূদ্ররা যেমন পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যে তফসিলি জাতির তকমা পান, ছত্তীসগঢ়েও সেই সুবিধা দিতে হবে। ছত্তীসগঢ় নমঃশূদ্র কল্যাণ সমিতির সভাপতি মন্মথ বিশ্বাস বলেন, ‘‘একাত্তরের যুদ্ধ পর্যন্ত মানুষ এসেছে। সব মিলিয়ে ১৬ থেকে ১৮ লক্ষ বাঙালি রয়েছে এ রাজ্যে। শুধু বস্তার ডিভিশনেই ৮ থেকে ১০ লক্ষ। তার মধ্যে কাঙ্কেরের পখানজোড়ে ১৩৩টি গ্রামে ৭ থেকে ৮ লক্ষ বাঙালি। শতকরা ৮০ ভাগ নমঃশূদ্র পৌন্ড্র রাজবংশী। কিন্তু তফসিলি জাতির সার্টিফিকেট নেই।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তফসিলি জাতির তকমার দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। বিজেপির রমন সিংহের সরকারের থেকে মানা ক্যাম্পের সিংহভাগ পরিবার বসতজমির পাট্টা পেয়েছেন। কিন্তু তফসিলি জাতির তকমা মেলেনি। রমন সিংহের আমলেই দশ হাজার বাঙালি রাজধানী রায়পুরে এসে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। কিন্তু আদিবাসী কল্যাণ দফতর সমীক্ষা চালিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে, বাঙালিদের মধ্যে জাতপাতের ভিত্তিতে অস্পৃশ্যতা নেই। তাঁরা সম্পন্ন, শিক্ষিত। জাতপাতের ভিত্তিতে পিছিয়ে থাকার প্রশ্ন নেই। অতএব সংরক্ষণেরও প্রয়োজনীয়তা নেই। মন্মথ বলেন, ‘‘বস্তার, কাঙ্কেরে আদিবাসী এলাকায় বাঙালিরা ঘাম ঝরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। অথচ সেখানকার স্কুল-কলেজের হোস্টেলে বাঙালি ছেলেদেরই জায়গা মেলে না। অন্তত স্কুলগুলোতে বাংলার শিক্ষক রাখার দাবি জানিয়েছিলাম। অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ করেও পরে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’
এক সময় বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু পরিবারগুলি কংগ্রেসের একচেটিয়া ভোটব্যাঙ্ক ছিল। কিন্তু গত ১০-১৫ বছরে বিজেপি-ও বাঙালিদের সমর্থন পেয়েছে। মানা ক্যাম্পে এখন পাশাপাশি উড়ছে কংগ্রেস, বিজেপির ঝাণ্ডা। কংগ্রেসের রাহুল গাঁধী-ভূপেশ বাঘেলের পাশেই বিজেপির নরেন্দ্র মোদী-রমন সিংহের ছবি নিয়ে প্রচার। ছত্তীসগঢ়ে ১৫ বছর পরে কংগ্রেসের সরকার এসেছে। এ বার লোকসভা ভোট। বাঙালি সংগঠনগুলি ঠিক করেছে, ভোট মিটে গেলে ফের দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের কাছে দরবার শুরু করবে।
কিন্তু বিজেপির নেতাদের নতুন হুঁশিয়ারি ছত্তীসগঢ়ের বাঙালিদের মধ্যেও আতঙ্ক তৈরি করেছে। সেই আতঙ্কের নাম— এনআরসি। মন্মথ বলেন, ‘‘বিজেপি নেতারা এসে বলছেন, ছত্তীসগঢ়েও এনআরসি হবে, বাংলাদেশিদের তাড়ানো হবে। এখানে তো কেউ বেআইনি ভাবে বাস করছে না। কিন্তু তা-ও একটা ভয় তৈরি হয়েছে।’’ এক বার শিকড় ছিঁড়ে উঠে আসা মানুষের মানা ক্যাম্পে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। আমাদের ভোটগুলোর দাম আছে তো? হরিসভা থেকে খোল-করতালে সুর ভাসে— ‘রাম রাম হরে হরে’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy