Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Religion

মানুষের বহুত্বেও আস্থা থাকুক বহু ঈশ্বরের দেশে

এই করিডর সেই করিডর নয়, এই কাশী আর আগের কাশী নেই— জানি রে বাবা, জানি। কিন্তু গঙ্গা তো সেই একই আছেন।

ছবি পিটিআই।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
বারাণসী শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:৫৬
Share: Save:

কেউ কেউ আমাদের ছোটবেলাকে সাংস্কৃতিক করে তোলার ‘গুরুদায়িত্ব’ নিয়েছিলেন। প্রজাতন্ত্র দিবস কিংবা নভেম্বর বিপ্লব পালনের প্রস্তুতি নেওয়ানোর সময়ে তাঁরা শুধুই বলতেন, ‘‘সভ্য হতে হবে, ভব্য হতে হবে।’’ এখানে, বারাণসীতে অবশ্য ‘ভব্য’ শব্দের অন্য মানে। পানের দোকান থেকে ঘাটের ঠেক— সর্বত্র জনতার মুখে শুনছি, ‘ভব্য’ করিডর তৈরি হচ্ছে। কিন্তু করিডর আবার ভব্য হয় কী করে? স্কুলবেলায় সে-ই তো ছিল যাবতীয় অভব্যতার জায়গা!

এই করিডর সেই করিডর নয়, এই কাশী আর আগের কাশী নেই— জানি রে বাবা, জানি। কিন্তু গঙ্গা তো সেই একই আছেন। গঙ্গাস্নান করে ভেজা কাপড়ে শিবদর্শন, মাটিতে জল চুঁইয়ে পড়বে আর জিভে উচ্চারিত হবে, ‘‘প্রণমামি শিবম শিব কল্পতরুম।’’ তবে না ভক্তির ষোলো কলা পূর্ণ হবে।

বাস্তবের হাতে ঐতিহ্যের ‘দূষিত হওয়ার সময়ে’ ভক্তির কথা বলাও কঠিন। ‘শোলে’ মুক্তি পাওয়ার পর থেকে যেমন, হেলেন বললে গ্রিক মহাকাব্যের নায়িকার কথা ভাবেন না বিশেষ কেউ। ‘সারদা’ কিংবা ‘ভক্ত’ শব্দগুলি উচ্চারিত হলেও ভিন্ন অনুষঙ্গ অনেকের মনেই চলে আসে।

তবু সেই দূষণ কত দিনের? পাঁচশো বছর পরেও সারদা মা, ভক্ত প্রহ্লাদ প্রাসঙ্গিক থাকবেন, আজকের সংযোগগুলো থাকবে না আর।

নট পাল্টে যায়, রাজা একই থাকে। চিরন্তন আর সাম্প্রতিকের সেই যুগলবন্দির নামই নটরাজ। আর তার সবচেয়ে বড় প্রতীক গঙ্গাজল, যা লক্ষ বছর শরীরে ধারণ করেও, একদম এই মুহূর্তের।

আচার্য শঙ্কর এই গঙ্গাকে নিয়েই লিখেছিলেন, ‘‘দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে/ ত্রিভুবন তারিণী তরল তরঙ্গে।’’ বিশ্বনাথ মন্দিরের সৌজন্যে কাশী নতুন করে সেজে ওঠার দিনেই খবর পেলাম, সাহিত্যিক নীরজা মাধবের আদি শঙ্করাচার্যের জীবনের উপরে আধারিত ‘‘অনুপমেয় শঙ্কর’’ উপন্যাসটি চিনের কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রমে থাকছে। যে সাংবাদিক বললেন, তাঁর মুখেই শুনলাম যে, ইউরোপের পাশাপাশি চিনেও এখন অদ্বৈত দর্শন পড়ার একটা ‘ক্রেজ়’ এসেছে।

বারাণসীতে এখন ক্রেজ় কী? ‘‘বচপনকা পেয়ার মেরা ভুল নহি জানা রে?’’

‘হর হর মহাদেব’-এর ভিতরে যে প্রত্যেক জীবের শিবত্ব লাভের কথা রয়েছে, তা গলা পেরিয়ে বুক পর্যন্ত পৌঁছয় ক’জনের? সবাই তো ‘হৃদয় সম্রাট’ হতে চায়, যখন কথা ছিল ‘হৃদয় ভিক্ষু’ হওয়ার।

প্রত্যেক হৃদয় থেকে ভালবাসা ভিক্ষে করে নেওয়ার পথই তো মহাদেবের পথ। বারাণসীর মন্দির সংস্কারে আরও অনেক দেব-দেবী পুনর্স্থাপিত হয়েছেন, জানলাম। ঈশ্বরের বহুত্বে হাজার-হাজার বছরের বিশ্বাস এই দেশের। মানুষের বহুত্বে বিশ্বাস না রাখলে সেই বিশ্বাস রক্ষা পাবে কী করে?

ব্যোম ব্যোম বললেই ওমিক্রন পালিয়ে যাবে না। তবু এই যে জীবনের পরোয়া না করে দিনে চোদ্দ-পনেরো ঘণ্টা ঘুরছি, তার একটা বড় কারণ, কাশীতে কাজ আর কাল এক হয়ে যায়। সময়ের সম্পাদ্য কষতে কষতেই পা রাখা যায় মহাসময়ে, দু’দণ্ড চুপ করে দাঁড়ালেই অনুভব করা যায়, ‘‘আসক্তি আর বৈরাগ্যের মাঝখানে মহাকাল/ দিনে ক্ষত্রিয়, রাতে ব্রাহ্মণ, সন্ধ্যায় চণ্ডাল।’’

সেই ব্রাহ্মণের হাত থেকে নির্মাল্য নিতে, ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে পা মেলাতে আর নশ্বর আমাকে, আকাশ-জল- মাটি-বাতাস-আগুনে মিশিয়ে দেওয়া চণ্ডালকে প্রণাম করতে আমাকে তো ফিরতেই হবে বারাণসীতে। প্রবোধকুমার সান্যালের ‘জনম জনম হম’ উপন্যাসে ভুগর্ভস্থ শিবের কথা পড়েছি, অলিগলিতে শুনেছি, ‘কাশীকে হর কংকর/ হ্যায় ভোলে শঙ্কর’। উঁচু গাছ যে রকম শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, সে ভাবেই মনে পড়েছে, কাশীর সর্বত্র দুর্গা আছেন বলেই, শিবের এত রমরমা।

শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, স্কন্দমাতা, মহাগৌরী, কালরাত্রি— নবদুর্গার প্রত্যেকেরই আবাস কাশীতে, শিবের পুজোয় কলসি করে মেয়েরা জল নিয়ে না এলে পুজোই হবে না! তাই হয়তো বিগত কয়েক দিন করে কলসযাত্রার ধুম এখানে। হরিশচন্দ্র ইন্টার কলেজ থেকে বিশ্বনাথ মন্দিরের দিকে যাওয়া এ রকম একটি মেয়েদের মিছিলের সামনে পড়ে গিয়ে মনে হল, রানি অহল্যাবাই শুধুমাত্র বারাণসীতে মন্দির সংস্কারই করেননি, তাঁর উদ্যোগেই এখানকার গঙ্গাজল মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এমনকি কর্নাটকের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তা-ও প্রায় আড়াইশো বছর আগে। তখন থেকেই কাশীতে একটি ছড়া লোকমুখে প্রচারিত, ‘‘খুবসুরতি দো পল কা হ্যায়/ রিশতা গঙ্গাজল কা হ্যায়।’’

যখন শুনলাম যে, আজও কাশীর ইতিউতি জলকষ্ট প্রবল আকার নেয় প্রতিটি গ্রীষ্মে, তখন মনে হল, সৌন্দর্যায়নের পাশাপাশি স্নান-পানের জলের প্রবাহ ঠিক করার ব্যবস্থা আর হবে কবে?

আর একটি বিষয় নিয়ে কাশীর বহু বাসিন্দা এবং সাধুদের আপত্তি। তা হল, রুদ্রকিশোরের নগরে গাঁজা-চরসের প্রতি প্রশাসন রুদ্র। অথচ মদের দোকান গজিয়ে উঠছে যত্রতত্র। লোকে যে নেশা করলে কোষাগারে কর জমা পড়বে, তার প্রতি সরকার কিঞ্চিৎ সদয়, ব্যাপারটা এমন কি? বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেও বিলাইতির দোকান দেখে প্রশ্নটা সঠিক বলেই মনে হল।

বারাণসীর পরিচয় শুধু আধ্যাত্মিক শহর হিসেবে নয়। পৃথিবীর মানচিত্রে বিদ্যাচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বারাণসীর দীর্ঘ দিনের স্থান। সংস্কৃত-বাংলা-আরবি-ফার্সির পাশাপাশি ইংরেজি চর্চারও দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে কাশীর। ইংরেজি ভাষার সঙ্গে স্বদেশিয়ানা কিংবা সনাতনের কোনও বিরোধ নেই। স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগোর ভাষণ কিংবা শ্রী অরবিন্দের উত্তরপাড়া অভিভাষণ— দু’টোই তো ইংরেজিতে দেওয়া! ইংরেজিকে সরিয়ে দিতে গেলে বিশ্বসাথে যোগই যে ছিঁড়ে যাবে! বাবা বিশ্বনাথ, কাশীনাথ হয়ে থাকবেন নাকি তখন?

বাবার ব্যবস্থা বাবাই করতে সক্ষম, তিনি তো সেই বটবৃক্ষের মতো, প্রতিটি বসন্তে যা যুবক হয়। মানুষের বয়স বাড়ে, ঈশ্বরের বয়স কমতে থাকে। তিনি ‘দাদু’ হন না কখনও। পিতাই থাকেন অনন্তকাল।

পিতা স্বর্গ, পিতাই ধর্ম। পিতৃদত্ত প্রাণ যেখানে ‘ভাল আছি, ভাল থেকো’ বলতে বলতে আকাশের ঠিকানায় চলে যায়, মণিকর্ণিকার সেই গঙ্গায় হাত অনেকখানি ডুবিয়ে অনুভব করলাম, পল এল্যুয়ারের সেই পঙ্‌ক্তি, আমার এমন কিছু নেই, যা আমাকে অন্যত্র নিয়ে যাতে পারে।’’

তখনই মনে প্রশ্ন এল, কাশী থেকে কী নিয়ে ফিরছি?

মনে মনে বললাম, ভোর চারটের নদীতে দাঁড়িয়ে ভরে নেওয়া এক জ্যারিকেন গঙ্গাজল। আর তার ভিতরের ভারতবর্ষকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Religion Kashi Vishwanath Temple varanasi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy