প্রতীকী চিত্র।
একটা সময় ‘উদ্বোধন’-এর কাজে অল্প একটু জড়িত ছিলাম। তখন একজনের বক্তব্য শোনার সুযোগ হত প্রায়ই। সেই সন্ন্যাসী যে কোনও প্রবচনই শুরু করতেন বিজ্ঞানের কোনও আবিষ্কারের কথা বলে। আজ আইনস্টাইন তো কাল নিলস বোর। একদিন ওঁকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় উনি বলেছিলেন, “ বেদ-উপনিষদ তত জানি না কিন্তু ফিজিক্সটা জানি। তাই নিজের ঘাটে টেনে আনার চেষ্টা করি বিষয়টাকে।’’ আনাতোল ফ্রাঁসের সেই গল্প— যেখানে একজন জাগলার মা মেরিকে জাগলিং দেখিয়ে আনন্দ দেবার চেষ্টা করত— ওঁর খুব প্রিয় ছিল। কুড়ি বছর আগের ঘটনা কুম্ভে এসে মনে পড়ল, নিজের ঘাটে টেনে নিয়ে আসার প্রসঙ্গে ।
‘‘ওই ঘাটে উনি বলছেন, যাবে নাকি শুনতে?’’ এ ওকে জানাচ্ছে এখানে হরবখত।
বলে তো সবাই, কিন্তু শুনে ঘোর লাগে, ক’জায়গায়?
নিজের হাতের কলকে অন্য একজনকে দিয়ে এক সন্ন্যাসী বলছিলেন, “আমার শহর, আমার গাঁও করে লোক! তুই তোর মহল্লার কোনও বড়লোকের বাড়িতে ঢুকতে পারবি, থাকতে পারবি রাতটা? মানুষের আপন হয় শুধু পথ, আর সন্ন্যাসীদের সেখানেই থাকা উচিত কারণ তাতে পথগুলো সুরক্ষিত থাকে।’’
সত্যিই তো! সাধারণ মানুষের জন্য রাস্তাই একমাত্র রাস্তা; ভারতপথিক আমরা সবাই, ভারত-সম্পদের অধিকারী আর কয়জন?
বিড়লা ঘাটের কাছে এক শ্বেতাঙ্গ সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ করলাম। বললেন, পল ব্রান্টনের ‘আ সার্চ ইন সিক্রেট ইন্ডিয়া’ পড়ে ভারতে এসেছিলেন প্রথম বার। তার পর থেকে আসছেনই।
‘‘পেলেন যা খুঁজছিলেন?’’ জানতে চাইলাম।
‘‘না।খুঁজতে গেলেই হারিয়ে যায়।’’
একটু নিচুগলায় জবাব দিয়ে সন্ন্যাসী তাঁর পাশে থাকা ভারতীয় মেয়েটির হাত ধরে এগিয়ে গেলেন।
‘হাফ-খরচে ফুল তৃপ্তি’ দেওয়া হরিদ্বারের এক বাঙালি হোটেল মালিক জানালেন, “সাধু হয়ে আসে, সংসারী হয়ে ফিরে যায়। এমনও অনেক দেখলাম।’’
হাসতে গিয়ে খেয়াল হল, সেই কবে, ‘তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ’ নামে বইটিতে লোকনাথ ব্রহ্মচারী এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্নেহধন্য নাগ মহাশয়ের গলায় এমনটাই শুনেছিলাম না?
বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গের ফলে শকুন্তলার জন্ম, শকুন্তলার থেকে উৎপত্তি ভরতের আর ভরত থেকেই ভারতবর্ষ! ভারতের ইতিহাস আসলে তপস্যা আর তপোভঙ্গের যৌথ ইতিহাস। একটিকে বাদ দিলে অপরটির অস্তিত্ব কোথায়? ঠিক যেমন স্রোত আর নাব্যতা মিলে নদী। ‘আমায় ডুবাইলি রে’ অসম্পূর্ণ, ‘আমায় ভাসাইলি রে’ না বলা পর্যন্ত।
কাল আবার শাহি স্নান! অজস্র সাধু আবারও গায়ের ছাই ধুয়ে ফেলবেন ‘ত্রিভুবনতারিণী তরলতরঙ্গে’। কিন্তু ছাই ধুয়ে গেলেও আগুন থেকে যায়।
শুনেছি, সাতের দশকের মাঝামাঝি অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্যের গ্রিক মহাকাব্য পড়াতে অসুবিধে হত ক্লাসে। কারণ ‘হেলেন’ তখন হোমারের থেকে বেশি রমেশ সিপ্পির। বাবার অনেক টাকা ডুবে যাওয়ায় ছোটবেলায় ‘সঞ্চয়িতা’ হাতে নিলে কী রকম ভয় করত আমার! তার পর ‘সারদা’ কিংবা ‘ভক্ত’ কত শব্দের গায়ে যে সময়ের কলুষ লাগল! সময়ই হয়তো সারিয়ে দেবে একদিন।
অল্প বয়সে একটি কবিতার বইয়ের নাম ‘রাজনীতি করবেন না’ দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। হরিদ্বারের কুম্ভের সবচেয়ে ভাল লাগার জায়গাটা হল, ‘চিৎকার করবেন না’। মাইকের ব্যবহার অত্যন্ত কম, কেউ খুব একটা হাঁকডাকও করছে না। চিৎকারে ঝালাপালা হয়ে যাওয়া জায়গা থেকে এসে, এই নীরবতা অতি উপাদেয়।
তবে সত্যিকার উপাদেয় ‘দাদা-বৌদির হোটেল’ নামে চলতে থাকা দশটা বাঙালি হোটেলের প্রায় প্রত্যেকটার রান্না (তিনটি পরীক্ষিত)। তামিলনাডু থেকে হিমাচল সেখানে লাইন দিয়েছে বাঙালির হাতের রান্না খেতে। কাল থেকে সবটুকু বিষ যে শুষে নিতে পারে, সে-ই কালী। আর হাতা-খুন্তির জাদুতে গোটা দেশকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে যে পারে, সেই বাঙালি।
কানসাসে ল্যারি স্টুয়ার্ট বলে এক ভদ্রলোক থাকতেন। লুকিয়ে পথবাসীদের ঝোলায় দশ-কুড়ি ডলার গুঁজে দেওয়ার অভ্যাসের কারণে লোকে ওঁকে ‘সিক্রেট সান্তা’ বলত। খেয়েদেয়ে ফেরার পথে গঙ্গার কোনও একটা ঘাটের কাছে কোনও একটা রাস্তায়, অনেক মানুষকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মনে হল, আমাদের অনেক সিক্রেট সান্তা দরকার। আর আমাদের নিজেদেরই তা হয়ে উঠতে হবে।
তখনই একটি মৃত কাককে ঘিরে চারপাশ থেকে উড়ে আসা কাকের কান্না শুনে চমকে গেলাম। তার পরই অন্ধকারে জলের ছলাতছলের মতো সহজ, স্বাভাবিক লাগল সব।
মৃতেরা পক্ষে না বিপক্ষে, সে বিচার তো কেবল মানুষই করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy