তিন সন্তান ও স্ত্রী রেহানার সঙ্গে সিদ্দিক মলপ্পুরমে। —নিজস্ব চিত্র।
ভালবেসে সাংবাদিকতায় এসেছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব থেকেই পৌঁছে গিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের হাথরসে। কিন্তু বর্তমানে সেই কাজটাই আর নেই।
কারণ, সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে কেরল থেকে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হয় উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ে। মাসে মোট চার বার। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সাংবাদিকের প্রশ্ন, ‘‘কোন সংবাদসংস্থা আপনাকে মাসে এত বার ছুটি দেবে, বলতে পারেন?’’
বর্তমানে জামিন পেয়ে পরিবারের সঙ্গে কেরলের মলপ্পুরমের বাড়িতে রয়েছেন দিল্লির মালয়লম সংবাদপত্রের প্রাক্তন কর্মী সিদ্দিক কাপ্পান। জানালেন, আপাতত ফ্রিলান্সার অনুবাদক তিনি। সামান্য কিছু আয় করছেন। স্ত্রী রেহানা কাপ্পানের পরিবার এবং সিদ্দিকের পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করছে। তাই দিয়েই সংসার চলছে। আগামী দিনে তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ কী ভাবে চালাবেন, তা নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তার উপরে প্রতি সপ্তাহের সোমবার স্থানীয় থানায় হাজির দিতে হয় কাপ্পানকে। পাশাপাশি, রয়েছে লখনউয়ে যাওয়ার অতিরিক্ত খরচ।
মঙ্গলবার মলপ্পুরম থেকে সিদ্দিক ফোনে বলেন, ‘‘বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই ২৮ মাস জেলে কাটিয়েছি। এখনও আমার বন্দিদশা কাটেনি। আমার দুটো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিজ় করা। ল্যাপটপ, জরুরি কাগজপত্র আদালতে জমা। সঞ্চয় নেই। চাকরি নেই। তার মধ্যে চোদ্দো দিন অন্তর লখনউয়ের আদালতে যেতে হচ্ছে। মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি সামাজিক, আর্থিক হয়রানি চলছে। আমার মনে হয়, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার এই বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে।’’
, হাথরসে গণধর্ষিতা, মৃত দলিত তরুণীর মৃতদেহ পোড়ানোর খবর করতে যাওয়ার পথে মথুরায় ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেফতার হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা করা হয়। অভিযোগ আনা হয়, তিনি উগ্রপন্থী সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া (পিএফআই) এবং তার শাখা সংগঠন ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া-র সঙ্গে যুক্ত। হাথরসে জাতপাতের লড়াই লাগানোর জন্য বিদেশ থেকে অর্থ নিয়েছেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেলেও ইডি-র করা আর্থিক তছরুপের মামলায় তাঁকে লখনউয়ের জেলে থাকতে হয়। ২৮ মাস কারাবাসের পর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জামিনে জেল থেকে ছাড়া পান।
সম্প্রতি ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে গুজরাত হাই কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট এক সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দিলেও ফের তাঁর জেলে ঢোকার সম্ভাবনা এড়ানো যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় অভিযুক্ত, সিদ্দিক কী ভাবছেন? তাঁর জবাব, ‘‘এখন আমার বিরুদ্ধে দুটো মামলা চলছে। কিন্তু এজলাসে মামলা উঠছেই না। অন্য দিকে, পুলিশ যে পাঁচ হাজার পাতার চার্জশিটের কথা বলেছিল, তার মধ্যে হাতে পেয়েছি মাত্র একশো পাঁচ পাতা। বাকি চার্জশিট পেশই করতে পারেনি পুলিশ। ইলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনউ বেঞ্চ পুলিশকে দ্রুত চার্জশিট পেশ করার নির্দেশ দিয়েছে।’’
সাংবাদিকের মতে, এটা সুস্থ-স্বাভাবিক যাপন নয়, টিকে থাকা। সিদ্দিক বলেন, ‘‘বাচ্চাগুলোর মনে আতঙ্ক রয়ে গিয়েছে। বাবাকে ছাড়া ওরা যে সময় কাটিয়েছে, সে ভয় এখনও যায়নি। তবে কেরলের সকলে আমার পরিবারের পাশে ছিলেন।’’
সম্প্রতি হনসল মেটার পরিচালনায় ‘স্কুপ’ ওয়েব সিরিজে দেখানো হয়েছে, এক ক্রাইম রিপোর্টার কী ভাবে মিথ্যে মামলায় জেলে যান। সাংবাদিক জিগনা ভোরার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি ওই সিরিজে দেখানো হয়, কী ভাবে জেলের ভিতরে মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটে সাংবাদিকের। ওই সিরিজ-শেষে সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানেরও উল্লেখ করা হয়।
কাপ্পান বলেন, ‘‘দাগি আসামিদের সঙ্গে আমায় জেলে রাখা হয়েছিল। কেউ ধর্ষণ করেছে, কেউ নেশাসক্ত। জেলে দুটো ইংরেজি খবরের কাগজ আসত। সেগুলো পড়েই মূলত সময় কাটাতাম। বন্দিদের পড়াতাম। ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা করতাম। রোজ খাবার পেতাম না।’’ তবে ভেঙে পড়েননি সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাজই ছিল ইউএপিএ, দলিত, সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্রীয় শোষণের উপরে খবর করা। জানতাম, এই আইনে একবার জেলে ঢুকলে জামিন পাওয়া বা ছাড়া পাওয়া শক্ত। তাই মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিলাম। মায়ের শেষকৃত্যে যাওয়ারও সুযোগ পাইনি।’’
সিদ্দিকের অভিযোগ, হাথরসে খবর করতে যাওয়ার পথে তাঁকে আটক করা হলেও পুলিশ বাড়িতে যোগাযোগ করেনি। মথুরা থেকে আটক করে, ২৪ ঘণ্টা তাঁকে বেআইনি ভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়। পরে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ স্থানীয় শাসক দলের পতাকা লাগানো ব্যক্তিগত গাড়িতে চাপিয়ে তাঁকে আদালতে নিয়ে যায়। তার পরের ২১ দিন সিদ্দিককে বিচ্ছিন্নবাসের অজুহাতে মথুরার এক স্কুলের ক্লাসঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে শৌচকাজের ন্যূনতম পরিকাঠামোও ছিল না। সিদ্দিক বলে, ‘‘একটা ক্লাসঘরের মধ্যে ৫০-৬০ জন আসামিকে রাখা হয়েছিল সেখানে। বিচ্ছিন্নবাস কী ভাবে হল?’’
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়ে মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ সিদ্দিক। বলেন, ‘‘মারধর চলত। এনকাউন্টার করে দেওয়ার ভয় দেখানো হত। গুলি করে মেরে দেওয়া হবে, এমন হুমকিও শুনেছি। এখনও যে আমায় আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হয়, ভয়ে ভয়ে থাকি। উত্তরপ্রদেশে পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতার চক্র চলছে। আইনের শাসন বলে কিছু নেই।’’
রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ নিয়ে কী ভাবেন সিদ্দিক কাপ্পান? জবাবে বলেন, ‘‘শাসক নিজের ক্ষমতাবলে আফস্পা, ইউএপিএ-র মতো আইন ব্যবহার করছে বিরোধী স্বর কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। সাংবাদিক, দলিত, সংখ্যালঘু মানুষকে জেলে ঢোকানো হচ্ছে। দেশের বিচারব্যবস্থার উপরে আমার আস্থা রয়েছে। কিন্তু সেই বিচারব্যবস্থাকে যেন কোনও রাজনৈতিক দল প্রভাবিত করতে না পারে। সেই সূক্ষ্ম সীমারেখা টানার কাজ বিচারব্যবস্থাকেই করতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy