Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Jharkhand Assembly Election 2024

ঝাড়খণ্ডের অরণ্যে হেমন্তই পোস্টম্যান! রাঁচীর বাতাসে প্রত্যাবর্তনের ‘হেমন্তকাল’, ব্যর্থ মোদী-শাহের প্রচার

বিধানসভা ভোটের প্রচারে মোদী, অমিত শাহেরা ধারাবাহিক ভাবে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রদেশের’ অভিযোগ করেছেন। নাম না করে নিশানা করেছেন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে। কিন্তু তাতে ফল মেলেনি।

JMM chief Hemant Soren led INDIA Alliance won in Jharkhand Assembly Election 2024

হেমন্ত সোরেন। ছবি: পিটিআই।

সায়ন ত্রিপাঠী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:২৯
Share: Save:

কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার সময় কংগ্রেস বিহার ভেঙে পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গড়তে সক্রিয় হয়নি। তিনি সেই দলের সহযোগী হলেন কেন?

২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটের আগে এই প্রশ্নের ঝটিতি জবাব দিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার (জেএমএম) প্রতিষ্ঠাতা শিবু সোরেনের পুত্র, ‘‘ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস কাদের রয়েছে? আমাদের, আদিবাসীদের আর কংগ্রেসের। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের সঙ্গে তো আমরাই রয়েছি।’’

পাঁচ বছর পর আর এক বিধানসভা ভোটের ফল বলে দিল, ভোটের অঙ্ক কষায় কোনও ভুল ছিল না। হেমন্ত সোরেনের ‘প্রত্যাবর্তন’ দেখল ঝাড়খণ্ড। ঘটনাচক্রে, হেমন্তকালেই। আড়াই দশকের পুরনো পূর্ব ভারতের আদিবাসীপ্রধান রাজ্যে এই প্রথম বার কোনও বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভা ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফিরতে চলেছেন।

JMM chief Hemant Soren led INDIA Alliance won in Jharkhand Assembly Election 2024

৮১ সদস্যের ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ৪১টি আসন। সহযোগী কংগ্রেস, আরজেডি এবং বামদল সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-কে সঙ্গে নিয়ে ৫২ ছুঁয়ে ফেলেছেন হেমন্ত। সহযোগী এনডিএ মাত্র ২৮। অবশিষ্ট আসনটিতে নির্দল। ৪৩টি কেন্দ্রে লড়ে ৩৩টিতে জিতে পরবর্তী বিধানসভায় বৃহত্তম দল হতে চলেছে জেএমএম। সহযোগী কংগ্রেস ৩০টিতে লড়ে ১৭, আরজেডি সাতটিতে লড়ে পাঁচ এবং সিপিআইএমএল (লিবারেশন) চারটিতে লড়ে দু’টিতে জিততে চলেছে।

অন্য দিকে, ৬৮টি আসনে লড়ে বিজেপির ঝুলিতে আসতে পারে মাত্র ২০টি! ২০১৯ সালের তুলনায় আসন এবং ভোট দুই কমছে পদ্মশিবিরের। তাদের দুই সহযোগী জেডি (ইউ), এলজেপি (রামবিলাস) একটি করে আসনে জিততে চলছে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিজেপির সমর্থনে ১০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী সুদেশ মাহাতোর ‘অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ (আজসু) মাত্র একটিতে জিততে চলেছে। অথচ ২০১৯ সালে একা লড়ে দু’টিতে জিতেছিল তারা।

বাড়তি-কমতির হিসাব

আসন কম পেলেও এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩২.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে শীর্ষে রয়েছে। যদিও ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ১ শতাংশ ভোট কমেছে তাদের। জেএমএম ২৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে। কংগ্রেস প্রায় ১৬ শতাংশ, আজসু সাড়ে ৩ শতাংশ, আরজেডি ৩ শতাংশের সামান্য বেশি এবং লিবারেশন ২ শতাংশ ভোট পেতে চলেছে।

২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে প্রায় সাড়ে ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছিল জেএনএম-কংগ্রেস-আরজেডির ‘মহাগঠবন্ধন’। সেই ভোটে আলাদা লড়ে সাড়ে ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বাবুলাল মরান্ডির ‘ঝাড়খণ্ড বিকাশ মোর্চা-প্রজাতান্ত্রিক’ (জেভিএমপি)। চলতি বছরের লোকসভা ভোটের আগে বাবুলালকে দলে টেনে রাজ্য সভাপতি করেছিল বিজেপি। কিন্তু ফল বলছে, সাহেবগঞ্জ-উত্তর ছোটনাগপুরের নেতা বিজেপিকে তেমন সুবিধা দিতে পারেননি।

অথচ মাত্র ছ’ মাস আগে লোকসভা ভোটে ঝাড়খণ্ডে কার্যত একতরফা জয় পেয়েছিল বিজেপি। ১৪টি আসনের মধ্যে আটটিতে জিতেছিল তারা। সহযোগী আজসু একটিতে। অন্য দিকে, জেএমএম তিন এবং কংগ্রেস দু’টিতে জিতেছিল। লোকসভা ভোটে এনডিএ ৪৭ এবং ‘ইন্ডিয়া’ ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কিন্তু ছ’মাসের মধ্যেই আমূল বদলে গেল পরিস্থিতি।

গুরুত্বপূর্ণ জয়-পরাজয়

বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন (বরহেট), তাঁর স্ত্রী কল্পনা (গাঁডেয়), ভাই বসন্ত (দুমকা) জিতেছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি বাবুলাল মরান্ডি (ধনওয়ার) জিতেছেন। কিন্তু প্রাক্তন জেএমএম বিধায়ক তথা হেমন্তের বৌদি সীতা এ বার জামতাড়ায় বিজেপি প্রার্থী হয়ে কংগ্রেসের ইরফান আনসারির কাছে হেরেছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা দলত্যাগী জেএমএম নেতা চম্পই সোরেন সেরাইকেলায় জিতলেও তাঁর পুত্র বাবুলাল ঘাটশিলায় হেরেছেন। দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়ার স্ত্রী তথা প্রাক্তন সাংসদ গীতা কোড়া (জগনাথপুর) এবং অর্জুন মুন্ডার স্ত্রী মীরা (পোটকা)-কে এ বার প্রার্থী করেছিল বিজেপি। হারের মুখে তাঁরা। তবে বিজেপির আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাসের পুত্রবধূ পূর্ণিমা জামশেদপুর (পূর্ব) আসনে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক তথা প্রাক্তন আইপিএস অজয় কুমারকে হারিয়েছেন। হেমন্ত মন্ত্রিসভার সদস্য তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামেশ্বর ওরাওঁ লোহারদগায় কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে জিতেছেন। প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী তথা আজসু প্রধান সুদেশ মাহাতো সিল্লিতে হারতে চলেছেন জেএমএমের যুবনেতা অমিত কুমারের কাছে।

কেন এমন ফল

পাঁচ মাসের জন্য হেমন্ত সোরেনের জেলযাত্রা ‘ইন্ডিয়া’র কাছে ‘শাপে বর’ হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডে জমি দুর্নীতি সংক্রান্ত বেআইনি আর্থিক লেনদেনের মামলায় হেমন্তকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। গ্রেফতারির আগে মুখ্যমন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়েছিলেন তিনি। হেমন্তের অনুপস্থিতিতে চম্পইকে মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত করেন জেএমএম নেতৃত্ব। পাঁচ মাস রাঁচীর বিরসা মুন্ডা জেলে বন্দি থাকার পরে গত ২৮ জুন ঝাড়খণ্ড হাই কোর্টের নির্দেশে মুক্তি পান হেমন্ত। তার পরেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন।

তার পরে ‘ক্ষুব্ধ’ চম্পইকে দলে টেনে এ বারের ভোটে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। তিনি নিজে সেরাইকেলায় জিতলেও ঘাটশিলায় হেরেছেন তাঁর পুত্র বাবুলাল। কোলহান ডিভিশনে (পূর্ব ও পশ্চিম সিংভূম, খরস‌ঁওয়া, সেরাইকেলা জেলা) জেএমএম-কংগ্রেস জোটকে রুখতে পারেননি চম্পই। অন্য দিকে, বিজেপির বিরুদ্ধে হেমন্তের তোলা চক্রান্তের অভিযোগ আদিবাসী সমাজে মান্যতা পেয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করেছেন, রাজনৈতিক চক্রান্ত করেই শিবু-পুত্রকে দুর্নীতি মামলায় ‘ফাঁসিয়েছে’ নরেন্দ্র মোদীর সরকার। পাশাপাশি, চম্পইয়ের বিরুদ্ধে জেএমএমের দেওয়া ‘গদ্দার’ তকমা বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়ে গিয়েছে। কতকটা ২০২১ সালে বাংলায় ‘নীলবাড়ির লড়াই’য়ে তৃণমূলের ‘গদ্দার’-তত্ত্বের মতোই। ঘটনাচক্রে, এ বার ঝাড়খণ্ডে বাঙালি ভোট পেতে বিজেপির ‘বাজি’ ছিলেন বাংলার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। আর কংগ্রেস ভরসা করেছিল প্রাক্তন সাংসদ অধীর চৌধুরীর উপর।

বিধানসভা ভোটের প্রচারে মোদী, অমিত শাহেরা ধারাবাহিক ভাবে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রদেশের’ অভিযোগ করেছেন। নাম না করে নিশানা করেছেন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে। স্লোগান দিয়েছেন, ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’। কিন্তু ভোটের ফলে স্পষ্ট যে, ওবিসি, দলিত এবং আদিবাসী ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে তাঁদের সেই কৌশল সফল হয়নি। বরং আদিবাসী মনে ছাপ ফেলেছে হেমন্তের পাল্টা প্রচার। প্রতিটি সভায় তিনি নিয়ম করে বলেছেন, ‘‘অনুপ্রবেশের কথা বলে বিজেপি এখানে সিএএ চালু করতে চাইছে। সেটা করে ওরা আদিবাসীদের জমি ছিনিয়ে নেবে। আমি যত দিন আছি, ঝাড়খণ্ডে সিএএ-এনআরসি চালু করতে দেব না!’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর আদলে হেমন্ত চালু করেছিলেন ‘মাইয়া সম্মান যোজনা’। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ বার ঝাড়খণ্ডে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ভোটদানের হার ছিল বেশি।

কুড়মি-মাহাতো ভোটে পাওয়ার লক্ষ্যে মোদী-শাহদের আজসুর সঙ্গে সমঝোতার কৌশলও কাজে লাগেনি। চলতি বছরেই তৈরি কুড়মি-মাহাতো জনগোষ্ঠীর নেতা জয়রাম মাহাতোর দল ‘ঝাড়খণ্ড লোকতান্ত্রিক ক্রান্তিকারী মোর্চা’ (জেএলকেএম) বেশ কিছু আসনে ভোট কেটে ‘ইন্ডিয়া’র জয় নিশ্চিত করেছে। বিজেপি শিবিরের একাংশের মতে, আদিবাসীদের জন্য তৈরি রাজ্যে ১০ বছর আগে (২০১৪ সালের বিধানসভা ভোটে জেতার পরে) ওবিসি নেতা রঘুবর দাসকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে ঝাড়খণ্ডে ‘হরিয়ানার খট্টর মডেল’ (জাঠপ্রধান রাজ্যে অ-জাঠ মুখ্যমন্ত্রী) চালু করে বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন মোদী-শাহেরা। কিন্তু তাতে স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কে। গত পাঁচ বছরে তা মেরামত করা যায়নি। মোছা যায়নি ‘আদিবাসী বিরোধী’ তকমাও।

পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্রে প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়েছে পুত্র উদ্ধব। কিন্তু পূর্বের ঝাড়খণ্ডে পিতা শিবুর মান রেখেছেন হেমন্ত। শনিবারের বারবেলা তেমনই বলছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Jharkhand Assembly Election 2024 Hemant Soren JMM INDIA Alliance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy