আইফেল টাওয়ারের তলায় যোগাসন। ছবি: এপি।
আমেরিকা থেকে আফগানিস্তান। প্যালেস্তাইন থেকে ইজরায়েল। রাশিয়া থেকে আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ বুরকিনা ফাসো। এক কথায়, গোটা বিশ্বকে ‘যোগ’ সূত্রে গেঁথে ভারতীয় বিদেশনীতিতে আজ একটি মাইলফলক রচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
১৫২টি দেশের প্রায় দু’শো জন কূটনৈতিক প্রতিনিধি আজ ভোরের রাজপথে একসঙ্গে বসে আসন করলেন। তা ছাড়া, ১৯১টি দেশে ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে উদ্যাপিত হল যোগ দিবস। নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতরে প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করা বক্তৃতা দেখানো হল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের পাশে বসে তা দেখলেন পাঞ্জাবি পরিহিত রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন। শুধু তা-ই নয়, সুষমাকে হিন্দিতে স্বাগত জানিয়ে তিনি বললেন, ‘‘নমস্তে, কেয়া হালচাল হ্যায়?’’
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েক হাজার বছরের পুরনো ভারতীয় ঐতিহ্যকে নতুন করে আন্তর্জাতিক স্তরে তা বিপণন করার কাজটি আজ সফল ভাবে সেরে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই সঙ্গে অর্থ, অস্ত্র, দর কষাকষি ছাড়াই ভারতীয় যোগকে ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে কাজে লাগিয়ে এক মেঘাচ্ছন্ন সকালে নয়াদিল্লি পৌঁছে গেল গোটা বিশ্বের দরবারে। শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, রাষ্ট্রপতিও এই উদ্যাপন থেকে দূরে থাকেননি। আজ রাষ্ট্রপতি ভবনের সব আমলা ও কর্মীদের নিয়ে যোগাসন করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। পরণে সাদা পোশাক। প্রথম বিশ্ব যোগ দিবসে রাষ্ট্রপতির এই অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে নিঃসন্দেহে এক বিশেষ বার্তা দিল।
সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল মোদী ক্ষমতায় আসার পরে পরেই। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রপুঞ্জে সাধারণ অধিবেশনে তাঁর প্রথম বক্তৃতাতেই আন্তর্জাতিক যোগ দিবস উদ্যাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন মোদী। সে সময় তাঁর আনা প্রস্তাবে সমর্থন করেছিল ১৭৭টি দেশ। আজ রাষ্ট্রপুঞ্জে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও বলেন, ‘‘যোগের কোনও ধর্ম নেই। সারা পৃথিবীকে একসূত্রে বাঁধতে পারে এই যোগ।’’ বিদেশমন্ত্রীর কথায়, ‘‘যোগের অর্থই হল মিলন, বন্ধন। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারত সারা বিশ্বের সঙ্গে নিজেকে একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছে। এবং তা সম্ভব হয়েছে যোগেরই সাহায্যে। আশা করি, যোগ ব্যবহার করে রাষ্ট্রপুঞ্জ সারা পৃথিবীতে ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেবে।’’
বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘যোগ ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু তাতে ভারতীয়ত্বের তকমা দেওয়াটাও প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল। এর ফলে গোটা বিশ্বের নতুন প্রজন্ম আবার যোগের উৎস সম্পর্কে নতুন করে অবগত হবেন। আগ্রহ বাড়বে ভারতের সমাজ-সংস্কৃতির উপর। আখেরে পুষ্ট হবে ভারতীয় বিদেশনীতি, যার প্রভাব অর্থনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে পড়তে বাধ্য।’’
আজ নয়াদিল্লির রাজপথে যে ‘বিশ্ব সম্মেলন’ দেখা গেল, রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশন ছাড়া শেষ কবে এমন দেখা গিয়েছে তা চট করে মনে করা যাচ্ছে না। প্রাক্তন কূটনীতিক রণেন সেন বলছেন, ‘‘যোগকে নতুন করে জনপ্রিয় করার এই উদ্যোগ যথেষ্ট প্রশংসনীয়। চিনও এ ভাবে তাদের সফ্ট পাওয়ারকে গোটা বিশ্বে বিপণন করে চলে।’’ প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিভাগে গবেষণারত রোহন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘দু’দেশের মধ্যে যে কোনও সরকারি দৌত্যকে আরও শক্তিশালী করে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ। ভারত সম্পর্কে যদি অন্যান্য রাষ্ট্রের আকর্ষণ এবং জ্ঞান বাড়ে তা হলেও সুবিধা পাওয়া যায়।’’
বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, শুধুমাত্র আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়তে অথবা ‘পুবে তাকাও’ নীতিতে জোয়ার আনতেই যে এই যোগ-কূটনীতি কাজ করবে শুধু তাই-ই নয়। পাশাপাশি যে সব দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি যথেষ্ট চাপের মধ্যে রয়েছে এবং ভারতের সাধারণ ভাবে যেখানে কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে, সেখানেও এই যোগ-উৎসব কিছুটা বাড়তি অক্সিজেন এনে দিতে পারে। আফগানিস্তানের হিরাটে (যেখানে সালমা বাঁধ তৈরি করছে ভারত) আজ যোগ উৎসব পালন করা হয়েছে। হিংসা আর আতঙ্কে মোড়া ওই অঞ্চলে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। সেখানে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অমর সিংহের বক্তব্য, যোগের এই ‘বিশ্বায়নের’ ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হয়ে উঠবে।
আফগানিস্তানে শান্তি ফেরানো নিয়ে সব চেয়ে উদ্বিগ্ন যে দেশ, সেই আমেরিকাও আজ হাজির রাজপথের যোগ উৎসবে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড বর্মার শরীর পঞ্চাশের কাছে পৌঁছেও মেদহীন, ছিপছিপে। রাজপথে পৌঁছলেন আয়ুষ মন্ত্রকের দেওয়া যোগ দিবসের লোগোওয়ালা শাদা টি শার্ট এবং কালো ট্র্যাক প্যান্ট পরে। যে ভাবে অবলীলায় সারলেন ৩৫টি যোগাসন, দেখেই বোঝা গেল এতে অভ্যস্ত তিনি। বললেন, ‘‘দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। যোগাসন আমার কাছে কঠিন কিছু নয়। এর ফলে টানটান হয়ে থাকা স্নায়ু অনেকটাই আরাম পায়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এই ঐতিহ্যের কোনও তুলনা হয় না। শরীর এবং মন— এই দুইয়ের শান্তি এবং ভারসাম্যের জন্য যোগ জরুরি। মার্কিন দূতাবাসে এটি খুবই জনপ্রিয়।’’ রিচার্ডের মতোই যোগব্যায়ামে একই রকম স্বচ্ছন্দ আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত আব্দালি। চার জন সঙ্গীকে নিয়ে আজ এসেছিলেন রাজপথে। বললেন, ‘‘আমাদের শারীরিক ব্যায়ামের প্রয়োজন রয়েছে। যোগের থেকে ভাল ব্যায়াম আর হয় না। আমি তো নিয়মিত যোগব্যায়াম করি।’’ তবে সব দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিই যে যোগাসনে দক্ষ, অথবা ঠিকঠাক হোমওয়ার্ক সেরে এসেছেন, তা নয়। যেমন প্যালেস্তাইনের দূতাবাস কর্তা এইচ এইচ হামজা। হিমসিম খেলেন অর্ধচক্রাসন বা ত্রিকোণাসন করতে গিয়ে। দূতাবাস সূত্রের খবর, যোগ নিয়ে ভারত তথা গোটা বিশ্বে নতুন করে হইচই পড়ে যাওয়ায় বিষয়টিতে সদ্য মনোনিবেশ করেছেন তিনি! আবার বুরকিনা ফাসোর নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইদ্রিসের দাবি, তিনি ২৭ বছর যোগাভ্যাস করছেন! তাঁর নিজের দেশে যোগকেন্দ্রও খুলেছেন। ইজরায়েল দূতাবাসের মুখপাত্র হোরসান্দির বক্তব্য, তেল আভিভেও যোগ দিবস সাড়া ফেলে গিয়েছে। প্রায় বিশ হাজার মানুষ সেখানে রবিবার যোগাসন করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ইজরায়েলবাসীরা যোগ খুবই পছন্দ করেন। তাঁরা যোগচর্চার জন্য ভারতে আসতে চান।’’ আজ রাজপথে যোগাসন করেছেন ভারত-সহ ৮৪টি দেশের ৩৫,৯৮৫ জন নাগরিক। দু’টিই বিশ্বরেকর্ড, জানিয়েছে গিনেস বিশ্ব রেকর্ড সংস্থা।
শুধু রাজধানীই নয়। বিভিন্ন দেশের ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে আজ গোটা বিশ্বই যেন যোগসূত্রে জড়িয়েছেন। শুধু আমেরিকা বা ইউরোপই নয় (যেখানে যোগসংস্কৃতি যথেষ্ট জনপ্রিয়) ‘আশিয়ান’ গোষ্ঠীভুক্ত রাষ্ট্রগুলিতেও উন্মাদনা চোখে পড়ার মতো বলেই জানাচ্ছেন বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা। আজ ভারতীয় সময় ভোর পাঁচটায় সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ জড়ো হন ব্যাঙ্ককের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁদের বিনামূল্যে টি শার্ট, খাবারদাবার এবং এনার্জি ড্রিঙ্ক দেওয়া হয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে। তাইল্যান্ডে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন সিংলার কথায়, ‘‘গোটা অনুষ্ঠানই দুর্দান্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উৎসাহীরা যোগ দিয়েছেন।’’ সে দেশের পর্যটন এবং ক্রীড়ামন্ত্রী কোবকার্ন ওয়াত্তানাভ্রাঙ্গুল ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানের প্রথমেই নরেন্দ্র মোদীর পাঠানো বার্তা পড়া হয়। ব্যাঙ্ককের পাশাপাশি একই ভাবে যোগ অনুষ্ঠান নিয়ে মগ্ন থেকেছে ফুকেত এবং পাতায়া, ভিয়েতনামের হ্যানয়, হো চি মিন সিটি, জাপানের টোকিও। ৪৭টি মুসলিম রাষ্ট্রও ভারতের সঙ্গে সরকারি ভাবে এই উৎসবের কো-স্পনসর হয়েছে। যার মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশ, তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, ওমান, কাতারের মতো দেশ। অবশ্য, অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক কোঅপারেশন-এর (ওআইসি) আটটি দেশ এই উৎসবে সামিল হতে চায়নি। তাদের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, মালয়শিয়া, এবং পাকিস্তান!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy