আর দশটা গতানুগতিক সফরের থেকে আলাদা কিছু নয়। শুধু একটা জিনিস নতুন।
নিজস্বী!
দুই শীর্ষনেতার। মোদীর তোলা। আর তাতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তিন দিনের চিন সফর নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। যদিও কূটনীতিকদেরই একটা বড় অংশ মনে করছেন, সেলফি-কাণ্ডের পরেও এই দুই দেশের মধ্যে বিরোধ এবং অবিশ্বাসের রূঢ় বাস্তবতা অনেকটাই অবিকৃত থেকে গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সেনাপতিরাও বলছেন, এই তিন দিনে এমন কিছু ঘটতে পারে না, যাতে ৫৩ বছরের পুরনো ক্ষত সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গেল। প্রাক্তন বিদেশ সচিব তথা প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন আবার মনে করেন, কোনও ম্যাজিক লন্ঠন দিয়ে মোদী এই সাবেকি দৃশ্যপটটা বদলে দিতে না পারলেও তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুসুলভ ভাবমূর্তির মাধ্যমে একটা অতি উৎসাহের আবহ তৈরি করেছেন।
সাউথ ব্লক সূত্র বলছে, চিন নতুন করে অর্থনৈতিক সিল্ক রুট তৈরি করছে। সেটা তৈরি করতে গিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও প্রত্যাহার করছে না তারা। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ চিন সমুদ্র পথে জাপানের যে নিরাপত্তার অভাববোধ, তা ভারতেরও শঙ্কার কারণ। বারবার বলা সত্ত্বেও চিন এখনও ওই অঞ্চলে তাদের কর্মকাণ্ড স্থগিত করেনি। তৃতীয়ত, সীমান্ত বিতর্ক নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলার মধ্যেই অরুণাচল নিয়ে চিনা সংবাদমাধ্যমে (যা কার্যত চিন সরকারের নিয়ন্ত্রণে) বিতর্ক উস্কে দেওয়া হয়েছে। অরুণাচলের একটা বড় অংশকে চিনের মানচিত্রে দেখানো হয়েছে ফের।
চিনের সরকারি সূত্র বলছে, ভারতও তাদের অবস্থান বদলায়নি। ভারতের পক্ষ থেকেও মোদীর সফরের প্রাক্কালে চিনকে কূটনৈতিক ‘ডিমার্শে’ পাঠানো হয়েছে। নেপাল এবং মায়ানমারে চিনের ভূমিকা নিয়ে, চিন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বারবার সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে কি এই ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ পরিস্থিতির জন্য মোদীর চিন সফর ব্যর্থ? মোদীর প্রতিপক্ষ শিবির তো বটেই, সোশ্যাল মিডিয়ারও একটা বড় অংশের বক্তব্য, চিন থেকে শূন্য হাতে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী। কূটনীতিকরা অবশ্য এতটা নেতিবাচক হতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত হাতি আর ড্রাগনে কোনও দিন বন্ধুত্ব হয়নি। ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ এই রোমান্টিসিজমের জন্য বড় মূল্য চোকাতে হয়েছিল জওহরলাল নেহরুকে। এখন ‘চিনি-মোদী ভাই ভাই’ স্লোগান তোলাটাও বাড়াবাড়ি। দু’দেশের মধ্যে ফাটল যে রকম ছিল, তেমনই থাকবে। কিন্তু কূটনীতির পরিভাষায় যাকে বলে ‘এনগেজমেন্ট’, সেটাকেও সক্রিয় রাখতে হয়। একবার চিনের প্রেসিডেন্ট ভারতে আসবেন, আর একবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী চিনে যাবেন— এ ভাবেই চলবে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর রাজীব গাঁধী প্রথম বেজিংয়ের সঙ্গে বরফ গলান। তার পর অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিংহ সেই এনগেজমেন্টটাই রেখে গেছেন। মোদী সেই কাজটাই করছেন, তবে আর একটু দক্ষতার সঙ্গে, কূটনৈতিক দামামা বাজিয়ে। প্রাক্তন কূটনীতিক বিবেক কাটজু বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা নিয়ে আপস করেননি। কিন্তু তিনি মৈত্রীর বার্তা দিয়েছেন। তা ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যটা কোনও নরম কূটনীতি নয়।’’
প্রাক্তন বিদেশ সচিব শ্যাম সারন বলেন, ‘‘চিনেও কিন্তু অনেক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে। একটা সময় চিন শুধু একটা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছিল। তারা গুণগত মান না দেখে, শুধু গোটা পৃথিবীর বাজার দখল করতে সস্তায় পণ্য সরবরাহ করতে মরিয়া ছিল। এখন বিশ্বায়নের দাপটে চিনকেও তার পণ্যের ব্র্যান্ডিং নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। সেখানেও শ্রমিক সমস্যা হচ্ছে। এই পরিস্থিতির সুযোগটা মোদী সরকার নিতে সচেষ্ট হয়েছে।’’
মোদীর নিজের বক্তব্য হল, চিন যদি কারখানা হয়, তা হলে ভারত তার ‘ব্যাকরুম’ দফতর হিসেবে কাজ করতে পারে। ভারতে ২০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আশ্বাসও তিনি বেজিং থেকে আদায় করেছেন।
মোদী তাঁর প্রথম ভাগে জাপান থেকে আমেরিকা— একাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রীর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পাশাপাশি চিনের সঙ্গেও সুসম্পর্ক স্থাপনের নমুনা দেখিয়ে তিনি ভারতের প্রচলিত ভারসাম্যের কূটনীতির পথেই হেঁটেছেন। শুধু সময়টা বদলে গেছে। এখন সংবাদমাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, পোশাক পরিচ্ছদ থেকে শরীরের ভাষা এ সবই কূটনীতিতে আগের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মোদী বলেন, ‘‘পৃথিবীর অন্তত কুড়ি জন রাষ্ট্রনায়ক এখন নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করেন। পৃথিবীতে বিশ্বনেতাদের কার্যত একটা ছোট ক্লাব তৈরি হয়েছে।’’ যেমন, চিনে যাওয়ার আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁকে ফোন করেছিলেন। তাই মোদী মনে করেন, মতপার্থক্য আছে বলেই কট্টরবাদী মনোভাব দেখাতে হবে, এমনটা নয়। বরং বাস্তবকে মাথায় রেখেই চিনের সঙ্গে খোলামেলা বন্ধুত্বের পথে হাঁটা উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy