Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Maharashtra and Jharkhand Assembly Election

ভান্ডারেই অচলা ভোটের লক্ষ্মী! ‘মমতা মডেলে’ ভর করেই মহারাষ্ট্র-ঝাড়খণ্ড ও অন্যান্য রাজ্যে কুর্সি দখল

গত জুন থেকে মহারাষ্ট্রের শিন্ডে সরকার ‘লাড় কি বহিন’ প্রকল্প চালু করেছিল। অন্য দিকে, ঝাড়খণ্ডে হেমন্তের সরকার গত অগস্ট থেকে ‘মাইয়া সম্মান’ প্রকল্পে টাকা ছাড়তে শুরু করেছিল।

Maharashtra and Jharkhand Assembly Election: Allowance for women acted as a Key factor

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১১:০৪
Share: Save:

নাম আলাদা। প্রভাব এক। বাংলায় যাহা ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, মহারাষ্ট্রে তাহাই ‘লাড় কি বহিন’ (আদরের বোন)। আবার উহাই ঝাড়খণ্ডে ‘মাইয়া সম্মান’ (মেয়েদের সম্মান)। সদ্যসমাপ্ত পশ্চিম ও পূর্ব ভারতের দুই রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফল স্পষ্ট করে দিল, ভান্ডারেই আসলে ভোটের লক্ষ্মী বসত করেন। পাশাপাশিই আরও এক বার দেখিয়ে দিল, দেশের রাজ্যে রাজ্যে ‘মমতা মডেল’ নিয়ে চললে ভোটে সাফল্য পাওয়া যায়। দেখিয়ে দিল, সারা দেশে সংক্রামিত হচ্ছে ‘দিদি’র বঙ্গীয় মডেল।

মাত্রই ছ’মাস আগে লোকসভা ভোটে মহারাষ্ট্রে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বিজেপি-শিবসেনা (শিন্ডে) জোট। ছ’মাস পরে সেখানেই অভাবনীয় জয় পেয়েছে তারা। তথ্য বলছে, মহারাষ্ট্রে মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। ভোটপণ্ডিতেরা মনে করছেন, ওই অতিরিক্ত ভোট শাসক জোটের পক্ষেই গিয়েছে। রাঁচীর কুর্সিতে হেমন্ত সোরেনের ফিরে আসার পিছনেও মহিলা ভোটের ‘অবদান’ রয়েছে। অর্থাৎ, দুই রাজ্যেই কাজ করেছে ‘ভান্ডারের রাজনীতি’। মাসের শেষে মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নগদ অর্থ। প্রমাণ হয়েছে, লক্ষ্ণী থাকলে ঝক্কি নেই।

তবে এই মডেলের প্রণেতা যে মমতা, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রাজ্য সরকারি সূত্রের খবর, অধুনা অবসরপ্রাপ্ত এক প্রবীণ আমলা প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মমতার গোচরে এনেছিলেন ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প। সেই শুরু। ওই প্রকল্পের সাফল্য মমতাকে তাঁর ‘দূরদৃষ্টি’র পথে আরও খানিকটা এগিয়ে দেয়। সেই থেকেই ‘লক্ষ্ণীর ভান্ডার’-এর ভাবনা শুরু। যা একান্ত ভাবেই মমতার মস্তিষ্কপ্রসূত। সেই ভাবনাকেই সাজিয়েগুছিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। নাম দিয়েছিলেন মমতা নিজেই। তার পর থেকে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তার পর থেকে মমতা ভোটের ময়দানে ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’। তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়া থামানো যায়নি। সদ্যসমাপ্ত ছ’টি উপনির্বাচনও সেই কথাই বলেছে। ২০২১ সালের ভোটের আগে মমতা বাংলার মহিলাদের নগদ অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভোটে জেতার পরে তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। দেখা গিয়েছে, লক্ষ্মীর ভান্ডারে ভর করেই বাংলায় একটার পর একটা নির্বাচনে জিতেছে তৃণমূল। মহিলা ভোটকে ‘সুসংহত’ রাখতে পেরেছেন মমতা।

একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভাতা দেওয়ার বিভিন্ন প্রকল্পকে ‘রেউড়ি রাজনীতি’, অর্থাৎ খয়রাতির রাজনীতি বলে কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে দেখা যাচ্ছে, তাঁর দল বিজেপিকেও সেই ‘খয়রাতি’র রাস্তায় হেঁটেই জয়ের গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। তা যেমন মধ্যপ্রদেশে সত্য, তেমনই মহারাষ্ট্রেও। বস্তুত, রাজ্য প্রশাসনের একটি অংশের আশঙ্কা, লক্ষ্ণীর ভান্ডারের ‘সাফল্য’ দেখে মোদীর সরকার না সারা দেশে এই মডেলেই একটি ‘কেন্দ্রীয়’ প্রকল্প চালু করে দেয়! তাতে তারাও মমতার মস্তিষ্কপ্রসূত প্রকল্পের ‘রাজনৈতিক সাফল্যে’ থাবা বসাবে বা বসানোর চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে মমতা কী করেন, তা-ও দেখার। যেমন তিনি ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর পরিবর্তে শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্প চালু করেছেন। তবে সে সব ভবিষ্যতের গর্ভে।

তবে এর একটি উল্টো পিঠও রয়েছে। প্রশাসনিক মহলের একটি অংশের বক্তব্য, অন্যান্য রাজ্য সরকার যখন তাদের রাজ্যে শিল্প গড়ার জন্য ‘ইনসেনটিভ’ (উৎসাহবর্ধক ভাতা) দিতে পারছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা দিতে পারছে না। কারণ, লক্ষ্ণীর ভান্ডারের মতো বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে। সম্প্রতি লক্ষ্ণীর ভান্ডারের উপভোক্তার সংখ্যা আরও বাড়িয়েছেন মমতা। প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে অর্থের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। তখন পরিকাঠামো-সহ অন্য নানা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ কমে যেতে পারে। আবার আধিকারিকদের অন্য অংশের বক্তব্য, মহিলাদের হাতে নগদ অর্থ আসার ফলে বাজারে কেনাবেচা বাড়ছে। যা সামগ্রিক ভাবে ‘গতিশীল’ অর্থনীতির সূচক। শিল্পস্থাপনের জন্যও যা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।

ব্যাখ্যা যা-ই হোক, মমতার এই প্রকল্পের ‘মার’ যে নেই, তা একের পর এক ভোটের ফলাফলে আরও স্পষ্ট হচ্ছে। লোকসভা ভোটের পরে মহারাষ্ট্রের একনাথ শিন্ডে সরকার ‘লাড়কি বহিন’ প্রকল্প চালু করেছিল। তাতে ঘোষণা করা হয়েছিল, মাসে মাসে মহিলাদের অ্যাকাউন্টে দেড় হাজার টাকা করে দেবে সরকার। ভোটের আগে একসঙ্গে পাঁচ মাসের টাকা, অর্থাৎ সাড়ে সাত হাজার টাকা করে পেয়েছিলেন মরাঠা মুলুকের মহিলারা। আবার ঝাড়খণ্ডে হেমন্তের সরকার গত অগস্ট থেকে ‘মাইয়া সম্মান’ প্রকল্পে টাকা ছাড়তে শুরু করেছিল। সেই অঙ্ক মাসে হাজার টাকা। দুই রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফল বলছে, শুধুমাত্র ওই প্রকল্পগুলির মাধ্যমে মহিলা ভোটের সিংহভাগ নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন দেবেন্দ্র ফডণবীস, একনাথ শিন্ডে, হেমন্ত সোরেনরা। যা মোট প্রাপ্ত ভোটের ১২-১৪ শতাংশ। অনেকের মতে, সেই কারণেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থাকলেও তা খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। যেমন একের পর এক ভোটে ফলতে পারছে না পশ্চিমবঙ্গেও।

প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রদেশে একই ধাঁচে ‘লাডলি বহনা’ প্রকল্প চালু করেছিলেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। ফলও মিলেছিল হাতে হাতে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছিলেন তিনি। যদিও তার পর তাঁকে আর মুখ্যমন্ত্রীর পদে রাখেনি বিজেপি। কর্নাটকেও কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলে ‘গৃহলক্ষ্মী’ প্রকল্পে মহিলাদের মাসে দু’হাজার টাকা করে দেবে। ভোটে জিতে তা বাস্তবায়িতও করেছেন সিদ্দারামাইয়া, ডিকে শিবকুমারেরা। একই রকম ভাবে চন্দ্রশেখর রাওকে তেলঙ্গানার গদি থেকে সরাতে কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষমতায় এলে তারা রাজ্যে ‘মহালক্ষ্মী’ প্রকল্প চালু করবে। দুই রাজ্যেই ক্ষমতা দখল করেছে কংগ্রেস।

প্রকাশ্যে যতই বিরোধিতা থাকুক বা সমর্থন, মহিলা ভোটে ভর দিয়ে ক্ষমতায় ফেরার পর ভিতরে ভিতরে কি এক বারও ‘দিদির জয়’ বলছেন না চৌহান-সিদ্দা-শিন্ডে-সোরেনরা?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy