মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরন। সোমবার। ছবি: পিটিআই।
কাজের বাজারের চাহিদা মেটাতে ২০৩০ পর্যন্ত প্রতি বছর ভারতে ৭৮.৫ লক্ষ চাকরির জোগান দরকার বলে জানাল আর্থিক সমীক্ষা। আয়ের দিক থেকে দেশের উপরের সারির ১ শতাংশ মানুষের ঝুলিতে দেশের মোট আয়ের ৬-৭ শতাংশ চলে যাচ্ছে— ধনী-গরিবের এই অসাম্যও গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ বলে মেনে নেওয়া হল।
বেকারত্বের সমস্যা, কর্মসংস্থান তৈরির চ্যালেঞ্জ এবং ধনী-গরিবের মধ্যে আর্থিক অসাম্য—লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীকে এই তিন বিষয়েই বিরোধীদের কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। আজ কেন্দ্রীয় সরকারেরই আর্থিক সমীক্ষা বিরোধীদের আর্থিক সমালোচনায় কার্যত সিলমোহর দিল। আর্থিক সমীক্ষা বলল, বেসরকারি শিল্পমহলকে কর্মসংস্থান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। আর্থিক অসাম্য রুখতে আগামী বছরগুলিতে কর নীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কোটিপতিদের উপরে বাড়ি কর চাপানোর সম্ভাবনা উস্কে দিয়ে আর্থিক সমীক্ষায় ইঙ্গিত, গরিব মানুষের শ্রম থেকে আয় ও ধনীদের পুঁজি থেকে আয়ের উপরে কর চাপানোর ক্ষেত্রে আলাদা নীতি প্রয়োজন।
মঙ্গলবার তৃতীয় মোদী সরকারের প্রথম বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তার আগে আজ তিনি সংসদে দেশের অর্থনীতির হাল-হকিকত নিয়ে মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরনের তৈরি আর্থিক সমীক্ষা পেশ করেছেন। নাগেশ্বরন তাঁর সমীক্ষায় মোদী সরকারকে বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন, ‘বাস্তব পরিস্থিতি’ মাথায় রেখেই সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি তৈরি করতে হবে। সেখানে কোনও রকম ‘মতাদর্শ’ বা ‘তত্ত্বগত ভাবনা’কে জায়গা দেওয়া চলবে না। তাঁর কথায়, ‘‘বাস্তবধর্মিতাকে নীতি তৈরির মন্ত্র করতে হবে। আমরা খুবই চ্যালেঞ্জিং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি। কোনও রকম মতাদর্শ বা তত্ত্বগত ভাবনাকে জায়গা না দিয়ে সমস্ত সম্ভাব্য পথে চেষ্টা করতে হবে।’’ তাঁর বক্তব্য, কর্মসংস্থান তৈরি, চাকরির দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ, কৃষি ক্ষেত্রের পুরো ক্ষমতা কাজে লাগানো, আর্থিক অসাম্যের মোকাবিলা, চিনের চ্যালেঞ্জ সামলানো, ছোট-মাঝারি শিল্পের অগ্রগতির পথে বাধা কাটানো, তরুণ প্রজন্মের স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে নজর রেখে নীতি তৈরি করতে হবে।
এই ‘বাস্তব পরিস্থিতি’-র কথা মাথায় রেখেই আজ মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, চলতি অর্থ বছর বা ২০২৪-২৫-এ আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে থাকবে। প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, গত অর্থ বছর, ২০২৩-২৪-এ আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ। সেই তুলনায় চলতি বছরের বৃদ্ধির হারের পূর্বাভাস কম। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাই এর থেকে বেশি হারে বৃদ্ধির পূর্বাভাস করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের অন্তর্বর্তী বাজেটেও ৭% বৃদ্ধির পূর্বাভাস করা হয়েছিল। কিন্তু নাগেশ্বরণের যুক্তি, তিনি ‘নিরাশাবাদী’ নন। আন্তর্জাতিক ভূ-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সব দেশেরই জাতীয়তাবাদ ও আত্মনির্ভরতার দিকে জোর, কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তির উত্থান, জলবায়ুর পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় রেখেই তিনি ‘সতর্ক’ হয়ে পূর্বাভাস করছেন। কারণ নতুন করে আন্তর্জাতিক সংঘাত তৈরি হলে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি হবে। তার মোকাবিলায় সুদের হার বাড়ানো হলে লগ্নি কমে গিয়ে অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগতে পারে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
কর্মসংস্থানের প্রশ্নে আর্থিক সমীক্ষা জানিয়েছে, বেসরকারি শিল্পকে কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় ভূমিকা নিতে হবে। যোগ্য চাকরিপ্রার্থী তৈরি করতে উচ্চ শিক্ষা নীতিকে সহায়ক হতে হবে। একই সঙ্গে সাবধানবাণী হিসেবে বলা হয়েছে, কৃত্রিম মেধা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সব স্তরের কর্মীদের চাকরির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। বিশেষত বিপিও-র ক্ষেত্রে এআই বড় বিপদ হয়ে উঠতে পারে। তবে ঠিক মতো নীতি নিলে এআই কর্মীদের দক্ষতার অভাব পূরণ করতেও পারে। বস্তুত এই প্রথম কোনও সরকারি নথিতে এআই-এর বিপদ সম্পর্কে বলা হল।
ধনী-গরিবের অসাম্য নিয়ে আর্থিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক স্তরেও ক্রমবর্ধমান অসাম্য নীতি নির্ধারকদের কাছে চিন্তার কারণ। ২০২২-এই ভারতের অসাম্যের পরিস্থিতি সংক্রান্ত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, উপরের সারির ১ শতাংশের ঝুলিতে দেশের মোট আয়ের ৬-৭ শতাংশ চলে যাচ্ছে। মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ কুক্ষিগত করছে। আজ আর্থিক সমীক্ষাও সে কথা মেনে নিল, যদিও লোকসভা ভোটের প্রচারের সময় নরেন্দ্র মোদী বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এই অসাম্যের অভিযোগ মানতে চাননি। সমীক্ষা রিপোর্ট কিন্তু বলছে, অসাম্য কমাতে শ্রম ও পুঁজি থেকে আয়ের ক্ষেত্রে কর নীতি আগামী বছরগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। কৃত্রিম মেধা বা এআই-এর ফলে আয় কমে যাওয়া বা কাজ হারানো মানুষের জন্য আর্থিক ভর্তুকির প্রয়োজনের দিকেও ইঙ্গিত করেছে আর্থিক সমীক্ষা।
আর্থিক সমীক্ষা মেনে নিয়েছে, গত দু’বছর ধরে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি চিন্তার কারণ। কিন্তু তার জন্য দায়ী প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, জলবায়ুর পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টার মতে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়ে-বাড়িয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কমাতে পারে না। কারণ এটা বাজারর চাহিদার সমস্যা নয়, জোগানের সমস্যা। সে ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা থেকে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বাদ দেওয়া নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন।
কৃষি ক্ষেত্রে বড় মাপের সংস্কারের সুপারিশ করে আর্থিক সমীক্ষা জানিয়েছে, এখন খাদ্য নিগমের গুদামে প্রয়োজনের তিন গুণ ধান রয়েছে। অতিরিক্ত ধানের উৎপাদনের ফলে সেচ, জল, বিদ্যুতে ভর্তুকির অপচয় হচ্ছে। ডাল, তৈলবীজ, মিলেটের মতো সব শস্যে সমান ভাবে উৎসাহ দেওয়া দরকার। মোদী সরকার ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দিয়ে ঢাক পেটালেও আর্থিক সমাক্ষায় বলা হয়েছে, খাদ্য সুরক্ষা থেকে পুষ্টি সুরক্ষার দিকে নজর ঘোরাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy