এনকাউন্টারের পর ঘটনাস্থলে তদন্তে পুলিশ। ছবি: পিটিআই
শুক্রবার সাত সকালেই হায়দরাবাদ এনকাউন্টারের খবর শুনে ঘুম ভাঙল দেশবাসীর। আর সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই দিকে দিকে তেলঙ্গানা পুলিশের প্রশস্তি। ‘ধর্ষক-খুনী’রা উচিত সাজা পেয়েছে, সর্বত্র এটাই হওয়া উচিত, শান্তি পেল ধর্ষিতার আত্মা— এমন সব পোস্ট, কমেন্টে ভরে উঠল সোশাল মিডিয়ার দেওয়াল। কিন্তু এর উল্টো স্রোতও বইছিল। এনকাউন্টার নিয়ে উঠতে শুরু করেছিল একাধিক প্রশ্ন। কেউ এনকাউন্টারের যথার্থতা নিয়ে, একটা অংশ প্রশ্ন তুললেন পুলিশে বয়ানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই। অসঙ্গতিও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন অনেকে।
অপরাধ ও অপরাধী নিয়ে চাকরি জীবন কাটিয়ে অবসর নেওয়ার পর প্রাক্তন পুলিশ কর্তাদের একটা অংশ ঘটনাক্রম মেলাতে পারছেন না। পুলিশের বয়ানও বিশ্বাসযোগ্য ঠেকছে না কারও কারও কাছে। আবার বিচার ব্যবস্থা পর্যন্ত না যেতে দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া সমান অপরাধ বলেও মনে করছেন। এতে গণতন্ত্র-বিচারব্যবস্থার ভিত নড়িয়ে দিতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
১০ পুলিশ, ৪ অভিযুক্ত
যে কোনও অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশের তদন্তের অন্যতম অংশ, অভিযুক্তদের দিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করানো। সাইবারাবাদের কমিশনার ভি সি সজ্জানরের দাবি, শুক্রবার ভোরেও পুলিশ সেই উদ্দেশেই গিয়েছিল। কেমন ছিল সেই পুলিশি বহর? পুলিশের বয়ান অনুযায়ী, অভিযুক্তরা ছিলেন চার জন। পুলিশকর্মী-অফিসারের সংখ্যা ছিল ১০। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যে ভয়ঙ্কর ঘটনা নিয়ে সারা দেশ তোলপাড়, সেই চিকিৎসককে গণধর্ষণ ও পুড়িয়ে খুনে অভিযুক্তদের ফাঁকা মাঠে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের কি আরও সতর্ক থাকার প্রয়োজন ছিল না? পুলিশের বয়ানে ধ্রুব সত্য ধরে নিলেও এনকাউন্টারের পরিস্থিতি কেন তৈরি হল, তার দায় কি এড়াতে পারে পুলিশ?
আত্মরক্ষায় গুলি
নিজের প্রাণ সংশয়ের পরিস্থিতি তৈরি হলে আত্মরক্ষায় গুলি চালানোর অধিকার রয়েছে পুলিশের। এ ক্ষেত্রে নিয়ম হল, প্রথমে অভিযুক্তকে আত্মসমর্পণের জন্য বলতে হবে। না মানলে পায়ে গুলি করতে হবে, যাতে সরাসরি অভিযুক্তের মৃত্যু না হয়। বরং আহত হয়ে প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং তার পর তাঁকে গ্রেফতার করে চিকিৎসা করানো যায়। এ ক্ষেত্রে কি হয়েছিল? সাংবাদিক সম্মেলনে সজ্জানর দাবি করেছেন, রুল বুক মেনে প্রথমে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয় চার অভিযুক্তকে। তাঁরা না শোনায় পুলিশ গুলি চালায় পুলিশ এবং চার জনেরই মৃত্যু হয়। প্রশ্ন হল, পা লক্ষ্য করে গুলি চালানো হল। প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনীর সেই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এমন ভাবে অভিযুক্তদের আঘাত করল যাতে ঘটনাস্থলেই চার জনের মৃত্যু হল?
মৃতদেহ উদ্ধার দুপুরে
পুলিশের গুলিতে চার জনেরই মৃত্যু হয়েছ, পুলিশকর্মীরা সেটা দেখেই বুঝে গেলেন। চিকিৎসকের সাহায্য পর্যন্ত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না? অথচ পুলিশের প্রাথমিক কাজই হল, দুর্গতকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে শুক্রবার দুপুরে। কে বলতে পারে, গুলি করার পর সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কাউকে বাঁচানোও সম্ভব হত। অনেকের মনেই প্রশ্ন, তবে কি পুলিশ নিশ্চিত ছিল, যে ভাবে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে, তাতে আর বাঁচবে না অভিযুক্তরা।
আরও পডু়ন: আমার স্বামীকে যাঁরা খুন করেছেন, তাঁদেরও হত্যা করুন, বলছেন অভিযুক্তের স্ত্রী
পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্র ছিনতাই
১০ জন বনাম ৪ জন। ১০ জন পুলিশকর্মী, যাঁরা অস্ত্রচালনা থেকে শুরু করে অপরাধীদের কাবু করা কিংবা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামলানোর মতো ঘটনায় প্রশিক্ষিত বাহিনী। বহু দাগী অপরাধীকে সামলানোর অভিজ্ঞতা তাঁদের রয়েছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, এমন একটি স্পর্শকাতর ঘটনার তদন্তে অভিজ্ঞ ও দক্ষ অফিসারদেরই পাঠানো হবে। উল্টোদিকে যাঁরা, তাঁরা দাগী আসামী নয়। অপরাধের পূর্ব ইতিহাসও তাঁদের নেই। এমন পরিস্থিতিতে ১০ জনের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেও মাত্র দু’জনের পক্ষে পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব কি? যদি সম্ভব হয়, তাহলে পুলিশের অপদার্থতাই প্রমাণিত হয়। এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চার জনের মৃত্যুর দায় কি তাঁরা এড়াতে পারেন?
এলোপাথাড়ি গুলি অভিযুক্তদের
পুলিশ কমিশনার সজ্জানরের দাবি, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে কেউ আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পারবেন না, এমন নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লোডেড আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগারে চাপ দিলেই গুলি চলে। কিন্তু অভিযুক্তরা যদি গুলি চালায়, তাহলে সেই গুলিতে পুলিশ কর্মীদের আহত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা। কারণ, অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া মানে অভিযুক্তরা পুলিশ কর্মীদের কাছেই ছিলেন। অনেক দূরে ছিলেন, এমন নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কেউ গুলিতে আহত হননি। যাঁরা এই প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা আবার এটাও বলছেন যে, অনেকে এর অন্য অর্থ করতে পারেন। সচেতন করে দিচ্ছেন, পুলিশ কর্মীদের কেউ আহত হলে তাঁরা উল্লসিত হতেন এমন নয়, বরং সেটা আরও বেদনাদায়ক হত।
আরও পড়ুন: অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন, কেউ বলছেন অন্যায়, তেলঙ্গানা এনকাউন্টার নিয়ে তোলপাড় দেশ
আহত দুই পুলিশকর্মী
পুলিশের যে দু’জন আহত হয়েছেন, তাঁদের অবস্থা স্থিতিশীল। মাথায়, গায়ে চোট-আঘাত লেগেছে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, তাঁরা বিপন্মুক্ত। কমিশনার সজ্জানর জানিয়েছেন, তাঁদের পাথর দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, লাঠি দিয়ে মারা হয়েছে। এই যুক্তিও অনেকের বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কারণ, পুলিশ কর্মীরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন। তা ছাড়া পুলিশ বাহিনী প্রশিক্ষিত ও দক্ষ। অভিযুক্তরা তা নয়।
নিহতদের পরিবারের দাবি
নিহতদের পরিবারের লোকজন অভিযোগ তুলেছেন, এনকাউন্টার নয়, ‘পরিকল্পিত খুন’। অর্থাৎ পরিকল্পনা করে ভুয়ো সংঘর্ষের নাটক সাজিয়ে চার জনকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ-খুনের অভিযোগ এক বারও অস্বীকার করেননি তাঁরা। পরিবারের সদস্যের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত পরিবার এমন দাবি করলে তাতে আবেগ বা শোকের বহিপ্রকাশ থাকতে পারে। প্রতিশোধস্পৃহাও জেগে উঠতে পারে।
কিন্তু আইনজীবী থেকে রাজনীতিবিদ, বিদ্বজ্জন থেকে প্রাক্তন পুলিশকর্তা— একটা বড় অংশের এই প্রশ্নও ফেলতে পারছেন না অনেকেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করে দেখছে। তেলঙ্গানার ডিআইজি-কে রিপোর্ট পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। আবার উল্টো দিকে কমিশনার সজ্জানরও বলেছেন, সরকার হোক বা কমিশন, সবার কাছেই তথ্যপ্রমাণ-সহ জবাব দিতে তাঁর বাহিনী প্রস্তুত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy