গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গোষ্ঠীহিংসা দীর্ণ মণিপুরে নতুন করে ‘সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন’ (‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট’ বা আফস্পা)-এর মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে খুশি নন ইরম শর্মিলা চানু। মণিপুরের মেয়ে, সমাজকর্মী শর্মিলা বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘গোষ্ঠী-সংঘাত ঠেকাতে ওই দমনপীড়নের আইন ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কোনও মতেই গ্রহণযোগ্য নয়।’’
মণিপুর থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম অনশনের নজির গড়ছিলেন শর্মিলা। ২০০০ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৬-র অগস্ট পর্যন্ত টানা ১৬ বছর ধরে জোর করে নাকে নল ঢুকিয়ে তরল খাবার দিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল প্রশাসন। অনশন প্রত্যাহারের পরেও মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে ধারাবাহিক প্রচার চালাচ্ছেন তিনি। শর্মিলা বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আফস্পা জারি করে কোনও ভাবেই মণিপুরে শান্তি ফেরানো যাবে না।’’
বুধবার মণিপুরের পাহাড়ি এলাকাগুলিতে আফস্পার মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১ অক্টোবর থেকে পরবর্তী ছ’মাস এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আফস্পা-তালিকা থেকে বাদ রাখা হয়েছে ইম্ফল উপত্যকার মেইতেই জনগোষ্ঠী প্রভাবিত ১৯টি থানা এলাকাকে। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণেই বেছে বেছে কুকি-জ়ো জনজাতি প্রভাবিত পাহাড়ি এলাকাগুলিতে আফস্পা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মণিপুরের বিজেপি সরকার। অরুণাচল প্রদেশ এবং নাগাল্যান্ডের কিছু এলাকাতেও বাড়ানো হয়েছে আফস্পার মেয়াদ।
কয়েক সপ্তাহ আগে কুকি-জ়ো জনজাতির সংগঠন ‘কমিটি অফ ট্রাইবাল ইউনিটি’ (সিওটিইউ) কেন্দ্রের কাছে ইম্ফল উপত্যকার সব জেলাতেই আফস্পা ফেরানোর দাবি তুলেছিল। এর পাশাপাশি, সংগঠনটির মণিপুরের কুকি এবং নাগা অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলের নিরাপত্তায় আবার অসম রাইফেলস মোতায়েনের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু মেইতেই প্রভাবিত মণিপুর সরকার এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেই দাবি কার্যত অগ্রাহ্য করেছে। এর নেপথ্যে ‘রাজনৈতিক অঙ্ক’ রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
গত ৩ মে জনজাতি ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’ (এটিএসইউএম)-এর কর্মসূচি ঘিরে মণিপুরে অশান্তির সূত্রপাত। মণিপুর হাই কোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরেই জনজাতি সংগঠনগুলি তার বিরোধিতায় পথে নামে। আর সেই ঘটনা থেকেই সংঘাতের সূচনা হয় সেখানে। মণিপুরের আদি বাসিন্দা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেইতেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকি, জ়ো-সহ কয়েকটি তফসিলি জনজাতি সম্প্রদায়ের (যাদের অধিকাংশই খ্রিস্টান) সংঘর্ষে এখনও পর্যন্ত প্রায় দু’শো জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘরছাড়ার সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার।
প্রসঙ্গত, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে জঙ্গি তৎপরতা মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনীর হাতে বাড়তি ক্ষমতা তুলে দিতে ১৯৫৮ সালে আফস্পা আইন জারি করেছিল কেন্দ্র। গত বছরের গো়ড়া পর্যন্ত উত্তর-পূর্বে এখন গোটা অসম, নাগাল্যান্ড, রাজধানী ইম্ফল বাদে মণিপুরের বাকি এলাকা এবং অরুণাচলের তিন জেলায় আফস্পা বলবৎ ছিল। এর পর ধাপে ধাপে অসম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের পর্ব শুরু করে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
২০২২ সালের এপ্রিলে অসমের ২৪টি জেলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল ওই আইন। এর পরে প্রধানমন্ত্রী মোদী উত্তর-পূর্বাঞ্চল সফরে গিয়ে বলেছিলেন, “অসম তথা উত্তর-পূর্বে নাশকতা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। উন্নত হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। তাই অসমের অধিকাংশ জেলা, নাগাল্যান্ড, এবং মণিপুরের বিভিন্ন অংশে আফস্পা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, উত্তর-পূর্বের যে সব এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বা নাশকতার সমস্যা নেই, সেই এলাকাগুলি থেকে পর্যায়ক্রমে আফস্পা তুলে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু মণিপুরে হিংসা পরিস্থিতি পুরো ‘অঙ্ক’ বদলে দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy