ব্রিটিশ লেখিকা কেটি হিকম্যান। নিজস্ব চিত্র।
ইংরেজি ক্লাসে কবিতা পড়তে গিয়ে হেসেই কুল পাচ্ছিল না ছেলেমেয়েরা। কী সব বলছিলেন মাস্টারমশাই! কবি লিখেছেন এক মেমসাহেব চাষির জীবনের কথা। মেমসাহেবরা চাষ করেন না কি! সাদা চামড়ায় আবার চাষ! উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত এগিয়ে চললেও এত কিছু ভেবে ফেলা সম্ভব হয়নি বেশির ভাগেরই। মেমসাহেবরা থেকেই গিয়েছেন সমস্ত সুখের ধারণা ঘিরে। মেমসাহেবদের অন্দরমহল যে সব সময়ে কেক-পুডিংয়ের মতো মসৃণ না-ও হতে পারে, তা কি সাধারণ ভারতীয় মননে ধরা পড়ার কোনও কারণ আছে? ঔপনিবেশিক শক্তি কি তেমন ভাবনার সুযোগ দিয়েছে কখনও? তাই বলেই কি ঔপনিবেশিক পুরুষতন্ত্র সুখে থাকতে দিয়েছে না কি তাদের ‘আপন’ নারীদের? নারীরা কখনও কোনও ক্ষমতার চোখে আপন হয়েছে না কি? ১৩তম জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভালে এসে তেমনই ভাবনা ছুড়ে দিলেন ব্রিটিশ লেখিকা কেটি হিকম্যান। আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে একান্ত আড্ডায় বসে বললেন, ‘‘ইতিহাস সব ভুলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সত্যি বলতে কি, ইংরেজ পুরুষদের এই বিশ্বজয়ের লোভের মুখে পড়ে বহু কষ্ট করতে হয়েছে সে দেশের মহিলাদেরও।’’
তাঁর নতুন বই ‘শি-মার্চেন্টস, বুক্কানিরস অ্যান্ড জেন্টেলউইমেন: ব্রিটিশ উইমেন ইন ইন্ডিয়া’-য় ঔপনিবেশিকতার ও-পিঠটা এ ভাবেই তুলে ধরেছেন ইতিহাসবিদ-সাহিত্যিক কেটি হিকম্যান। দুনিয়া জুড়ে যখন ‘ইমিগ্রান্টদের’ নিয়ে কথা হচ্ছে বার বার, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ভারতে পাড়ি দেওয়া ইংরেজদের ঘরণী-বান্ধবীদের রাখছেন তিনি। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্কাইভ ঘেঁটে দেখেছেন, কোনও কাজের টানে নয়, মূলত সংসার অটুট রাখতেই ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন অধিকাংশ মেমসাহেবরা। এঁদের অবশ্য আসলে ‘মেমসাহেব’ বলতে পছন্দ করেন না কেটি। বলেন, ‘‘মেমসাহেব কথাটার মধ্যে একটা সুখের ছাপ আছে। অনেকে সুখে থেকেছেন নিশ্চয়ই, তবে অনেকে আবার থাকেননি।’’
যেমন লিজ নামে এক মহিলার কথা মনে পড়ে কেটির। স্বামী কোম্পানির হয়ে কাজ নিয়ে চলে আসেন কলকাতা শহরে। কয়েক দিন পরে লিজও এসে সংসার পাতেন এখানেই। নতুন পরিবেশ, অন্য ধরনের জীবনযাত্রা, সবই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে সবটাই স্বামীর উপার্জনের উপরে ভর করে। তখন ইংরেজ মহিলাদের মধ্যে নিজের রোজগারের ভাবনাই বা কোথায়! তবে ভাবতে শুরু করতে হল, কিছু দিন পরেই। এক পয়সাও তাঁর হাতে না ঠেকিয়ে, এক ভারতীয় মহিলার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ঘর ছাড়লেন স্বামী। ‘পরিত্যক্তা’ সেই মেমসাহেবের তখন না রয়েছে কলকাতায় থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা, না রয়েছে দেশ ফেরার টাকা। ফলে এক অর্থে রিফিউজি জীবন শুরু হয় তাঁর। বড়লোক ভারতীয়দের বাড়ি গিয়ে গিয়ে কখনও দু’লাইন ইংরেজি বলা শেখানো, তো কখনও পুডিং বানিয়ে বিক্রি করে বহু দিন জীবন কেটেছে তাঁর।
আরও পড়ুন: প্রথম দিনের পর ‘ছপাক’-এর থেকেও পিছিয়ে থাকল কঙ্গনার ‘পঙ্গা’!
আরও পড়ুন: মায়েদের ছবি এঁকে সোনা জয় ছেলের, জানতেই পারলেন না মৃত মা
উনিশ শতকের কলকাতার ইতিহাস বলে, মেমসাহেবদের দেখে ঘরে ঘরে ভদ্রমহিলা তৈরি করার ঝোঁক বেড়ে গিয়েছিল বাঙালির। তবে যে ব্রিটিশ মহিলারা তাঁদের ‘ভদ্রমহিলা’ হতে সাহায্য করছিলেন, তাঁদের ঘর কতটা নির্বিঘ্নে ছিল, তা জানার সুযোগ হয়নি বিশেষ। কেটি সেই মহিলাদের কথা বলছেন গল্পে-ইতিহাসে। হায়দরাবাদে মহিলাদের জন্য একটি স্কুল চালাতে আসেন আর এক ব্রিটিশ নাগরিক। অবিবাহিতা তিনি। বিশাল কোনও ডিগ্রি পাওয়ার সুযোগ হয়নি, কারণ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনও মহিলাদের পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেয় না রানির দেশ। তবে ইংরেজি তো জানেন। মাতৃভাষাকে ভরসা করে চলে আসেন ভারতে। এ দেশের সর্বত্রই তখন ইংরেজি শিক্ষার হিড়িক উঠেছে মহিলাদের মধ্যেও। সম্ভবত হায়দরাবাদ শহরে মহিলাদের জন্য তৈরি হওয়া প্রথম ইংরেজি স্কুলটি তাঁরই গড়া। কিন্তু তাই বলেই কি তিনি যোগ্যতা অর্জন করলেন নিজের সমাজের বাকি গুরুত্বপূর্ণদের সঙ্গে মেলামেশা করার? মোটেই নয়। কেটি জানান, ব্রিটিশদের ক্লাবে যেমন ঢুকতে দেওয়া হত না ভারতীয়দের, তেমনই স্থান পাননি এই মহিলাও। ক্লাবে ঢোকার অনুমতি চাইলে তিনি জানতে পারেন, শুধু ব্রিটিশ জেন্টেলম্যানদের স্ত্রী জেন্টেলউইমেনরাই প্রবেশের অধিকারী সেখানে।
এ সব কথা এখন কেন শোনাচ্ছেন কেটি? এই গল্প পড়ে কি বদলে যাবে ভারতের ইতিহাস?
তা যে যাবে না, তা ভালই জানেন লেখিকা। তবু এমন সব গল্প নিয়ে উড়ে এসেছেন এ দূর দেশে, দুঃসময়ে গোটা দুনিয়ার সঙ্গে শামিল হবেন বলেই। জানাবেন সকলকে, পুরুষতন্ত্রের চেহারা সর্বত্র এক। তিনি বলেন, ‘‘ভারতের ইতিহাসে ব্রিটিশদের যে অবদান রয়েছে, তা আমাকে বার বার লজ্জিত করে। তবে আমাদের মহিলারাও সেই ক্ষতির কিছুটা শিকার।’’ কেটি বলে চলেন, ভারতে এসে ‘বড়’ হওয়ার হিড়িক বদলে দিয়েছিল গোটা ব্রিটির জগতে সংসারের ধারণাটাই। শিশুরা ৭-৮ বছরের হলেই পাঠিয়ে দেওয়া হত বোর্ডিং স্কুলে। মায়ের কোল খালি করে, সন্তানকে দূরে রেখে বড় করার রীতি এখনও ধরে রেখেছে ব্রিটেন। অথচ, তখন যুক্তি দেওয়া হত ভারতে যথেষ্ট ‘সুস্থ’ ভাবে বড় হতে পারবে না শিশুরা। তা আবার হয় না কি, প্রশ্ন করেন কেটি। মা যেখানে থাকবে, শিশুরা সেখানেই সবচেয়ে ভাল থাকবে। ‘‘ঔপনিবেশিক শক্তি নিজের সন্তানের ভালই বোঝেনি কখনও, বাকিদের কথা তোলাই থাক,’’ ঝাঁঝিয়ে ওঠেন লেখিকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy