ইতিহাস: এই সরু গলি দিয়েই জেনারেল ডায়ার ও তাঁর বাহিনী জালিয়ানওয়ালা বাগে ঢুকে নিরীহ মানুষের উপরে গুলি চালিয়েছিল। নিজস্ব চিত্র
গত একশো বছরে জালিয়ানওয়ালা বাগে অনেক বারই মেরামতির কাজ হয়েছে। কিন্তু একটা জায়গা অপরিবর্তিত ছিল। জালিয়ানওয়ালা বাগে ঢোকার পথে দু’পাশে ইটের দেওয়ালের মাঝে সরু গলি। যে গলি দিয়ে জেনারেল ডায়ার ও তাঁর বাহিনী ঢুকে নিরীহ মানুষের উপরে গুলি চালায়। এই গলিপথে ঢুকতে গেলে একশো বছর পরেও সে দিনের ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতি ফিরে আসত মানুষের মনে।
দীর্ঘদিন সংস্কারের জন্য জালিয়ানওয়ালা বাগ বন্ধ ছিল। শনিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নতুন করে সাজানো জালিয়ানওয়ালা বাগের উদ্বোধন করেছেন। তার পরে উদ্যানের দরজা খুলতেই দেখা গিয়েছে, পুরনো সেই দেওয়াল উধাও। ম্যুরালে সাজানো দেওয়ালে বসেছে নানা রকম মূর্তি। সরকারি সূত্রের খবর, সেই সব মূর্তি তৈরি হয়েছে কৃষ্ণনগরে।
জালিয়ানওয়ালা বাগের যে কুয়োতে ১৯১৯ সালের সেই ভয়ঙ্কর দিনে মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, সেই শহিদ কুয়োও ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। ফলে তার চেহারাই বদলে গিয়েছে। পুরো কুয়োটাই কাচের দেওয়াল দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। সৌন্দর্যায়নের জন্য মূল স্মারক ঘিরে একটি পদ্মফুলের সরোবর তৈরি হয়েছে। চালু হয়েছে লেজ়ার প্রযুক্তি সহযোগে নতুন লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। শনিবার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, নতুন করে সাজানো স্মারক ইতিহাস শিখতে সাহায্য করবে। অভিযোগ উঠেছে, সৌন্দর্যায়ন করতে গিয়ে আসল ইতিহাসই মুছে গিয়েছে।
ইতিহাসবিদ এস ইরফান হাবিব বলেন, “এ হল দেশের ঐতিহাসিক স্মারকের বাণিজ্যিকীকরণ। যেখানে হেরিটেজ মূল্য চলে গিয়ে আধুনিক কাঠামো তৈরি হয়। এই সব স্মারক যে সময়ের, সেই সময়ের চিহ্ন ধরে রেখে তার দেখাশোনা করা উচিত।” লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক কিম এ ওয়াগনারের মন্তব্য, “আমি স্তম্ভিত। এর অর্থ হল, জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনার শেষ চিহ্নও মুছে দেওয়া হল।”
জালিয়ানওয়ালা বাগ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রধান খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ট্রাস্টে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহও রয়েছেন। মোদী সরকারের জমানায় আইন সংশোধন করে ট্রাস্ট থেকে কংগ্রেস সভাপতিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। জালিয়ানওয়ালা বাগ-কাণ্ডের শতবর্ষ উদ্যাপনের জন্য স্মারকের সংস্কারের কাজে ২০ কোটি টাকা খরচ হয়। আর্কিওলজিকাল সার্ভে, সংস্কৃতি মন্ত্রকের নজরদারিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনবিসিসি কাজ করেছে। সূত্রের খবর, গুজরাতের একটি সংস্থাকে এর ঠিকা দেওয়া হয়েছিল।
কংগ্রেসের প্রশ্ন, বিজেপি কি ব্রিটিশদের অত্যাচারের ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে? কংগ্রেস নেতা গৌরব গগৈ বলেন, “আমি এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নানা রঙের ডিস্কো আলো লাগানোর বিরুদ্ধে। এতে জালিয়ানওয়ালা বাগের গুরুত্ব ও আতঙ্ক কমে গিয়ে বিনোদনে চলে যায়। সংসদ ভবনেও এখন এ রকম আলো লাগানো হয়েছে।” সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “দিল্লিতে সেন্ট্রাল ভিস্টায় কী রকম মোদী-আবাদ তৈরি হবে, এ হল তার পূর্ব লক্ষণ। জাদুঘর, ন্যাশনাল আর্কাইভের হেরিটেজ কাঠামো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। জালিয়ানওয়ালা বাগের প্রতিটা ইট ব্রিটিশ রাজত্বের ভয়ঙ্কর চিহ্ন। যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে ছিল না, শুধুমাত্র তারাই এই কেলেঙ্কারি করতে পারে। এটা শহিদদের প্রতি অপমান।”
গোটা বিষয়টি নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রক অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটেছে। ট্রাস্টের সচিব সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমি এখনই এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাইছি না।” সুকুমারেরা তিন প্রজন্ম ধরে জালিয়ানওয়ালা বাগের দেখাশোনার দায়িত্বে। জালিয়ানওয়ালা বাগের শহিদদের পরিবারও এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে শহিদি কুয়ো ভেঙে নতুন করে তৈরির বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদও জানিয়েছেন। কিন্তু কোনও কথায় কান দেওয়া হয়নি। ‘জালিয়ানওয়ালা বাগ ফ্রিডম ফাইটার্স ফাউন্ডেশন’ ভবিষ্যতের সমস্ত সরকারি কর্মসূচি বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর কাছে শহিদদের পরিবারের জন্য তাম্রপত্রের আর্জি জানিয়েও কোনও সাড়া মেলেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy