অস্ত্রোপচারের পরে হাসপাতালে বিনোদ সাহু।—নিজস্ব চিত্র।
দু’টো গুলি খাওয়া লোকটার তড়িঘড়ি এক্স-রে করার পর সেই ছবি দেখে বিভাগীয় কর্মীদের জোর বকাবকি করেছিলেন রাঁচির বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা। এমন মরণাপন্ন রোগীর উল্টো এক্স-রে হয় কোন যুক্তিতে? অগত্যা দ্বিতীয় এক্স-রে এবং একই ফল। ডাক্তাররা দেখলেন, গুমলা জেলার বছর তিরিশের বিনোদ সাহুর হৃৎপিণ্ডটা সত্যিই রয়েছে ডান দিকে। আর বুকের বাঁ দিকে, যেখানে আর পাঁচটা মানুষের হৃৎপিণ্ড থাকে, ঠিক সেই জায়গাটায় বিঁধে রয়েছে একটা গুলি।
রুদ্ধশ্বাস গোয়েন্দা কাহিনির দেবাশিস ভট্ট আর রক্তমাংসের ঝাড়খণ্ডবাসী বিনোদ সাহুকে মিলিয়ে দিল একই ভাগ্যের ফের। ব্যোমকেশ বক্সীর একনিষ্ঠ ভক্তরা কী ভাবছেন, আন্দাজ করার জন্য গোয়েন্দা হওয়ার দরকার নেই। হুবহু বাস্তবের ‘শজারুর কাঁটা’! আর কী আশ্চর্য, কলকাতায় এখন ভরপুর ব্যোমকেশ-আবহ। দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিন্দি ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ মুক্তি পেয়েছে আজই। আর একটি বাংলা ব্যোমকেশও পর্দায় এসেছে দিন কয়েক আগে। আশ্চর্য সমাপতন, সেটি হল— শজারুর কাঁটা!
গল্পের দেবাশিসকে খুন করতে তাঁর পিঠের বাঁ দিকে একটি শজারুর কাঁটা বিঁধিয়ে দিয়েছিল আততায়ী। জানত না, দেবাশিসের ‘সব কিছুই উল্টো’। তাই ফুসফুস জখম হলেও তাঁর হৃদয় ছিল অক্ষত। বিনোদের বেলায় আততায়ীরা খুব ভেবেচিন্তে বুকের বাঁ দিক লক্ষ্য করেই গুলি চালিয়েছিল, এটা বলা যাচ্ছে না। মোটরবাইকে এসে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে বিনোদকে পরপর দু’টো গুলি করেই চম্পট দিয়েছিল তারা। ডাক্তাররা বলছেন, গুলি যে পথে শরীরে ঢুকেছে, সেটাই মৃত্যু ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু বিনোদের শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কলকব্জার স্বাভাবিকের বিপরীত অবস্থানই তাঁকে জোর বাঁচিয়ে দিয়েছে এ যাত্রা।
গত ৩১ মার্চ ভোরের ঘটনা। ঝাড়খণ্ডের ভরদা গ্রামে নিজের খেতে কাজ করছিলেন বিনোদ। সেখানেই তাঁর ওপরে হামলা চালায় মুখঢাকা দুই আততায়ী। খবর পেয়ে ছুটে আসেন বাড়ির লোকেরা। রক্তাক্ত বিনোদকে তাঁরা নিয়ে যান গুমলা জেলা সদর হাসপাতালে। কিন্তু সম্ভবত পুলিশের ঝামেলা এড়াতেই বিনোদকে ভর্তি নিতে চাননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শেষ চেষ্টা হিসেবে রাঁচির একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। এ বার আর ভর্তি করতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু বিনোদ তত ক্ষণে নেতিয়ে পড়েছেন। হাল ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাটিও শুরু করে দিয়েছেন পরিজনদের একাংশ।
কতকটা সেই সময়েই হাসপাতালের ডাক্তাররা চমকে উঠছিলেন বিনোদের এক্স-রে দেখে। গুলির অবস্থান জানতে আগে এক্স-রে করাটাই দস্তুর। হাসপাতালের মিডিয়া উপদেষ্টা আনন্দপ্রকাশ শ্রীবাস্তব পরে বলছিলেন, ‘‘প্রথম এক্স-রে করার পর মনে হয়েছিল, টেকনিশিয়ানরা কোনও ভুল করেছে। পুরো ছবিটাই ছিল উল্টো। তখন ডাক্তারেরা দাঁড়িয়ে থেকে ফের এক্স-রে করানোর পর একই জিনিস দেখতে পান। এর পরই গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়।’’ শুধু ডান দিকে হৃৎপিণ্ড নয়, দেখা যায়, বিনোদের যকৃত, গলব্লাডার ও অ্যাপেনডিক্সের অবস্থানও সাধারণ মানুষের উল্টো। অর্থাৎ সেগুলি থাকার কথা ডান দিকে, বিনোদের
রয়েছে বাঁ দিকে।
বাড়ির লোকেদের আশা হারাতে বারণ করেন ডাক্তাররা। শুরু হয় অস্ত্রোপচার। দেখা যায়, একটা গুলি বিনোদের পেটের ডান দিক থেকে ঢুকে যকৃতের একাংশ জখম করে বুকের বাঁ দিকে যেখানে সাধারণ মানুষের হৃৎপিণ্ড থাকে, সেখানে গিয়েই আটকে রয়েছে। তবে শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। প্রায় দু’ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে বিনোদের তলপেট থেকে প্রায় তিন লিটার জমা রক্ত বের করা হয়। সফল অস্ত্রোপচারের পর জ্ঞানও ফিরেছে বিনোদের।
‘শজারুর কাঁটা’য় ডাক্তার গুপ্ত বলেছিলেন, এমন উল্টো ছবি ‘কোটিকে গুটিক মিলে।’ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা কী? ডাক্তারেরা জানাচ্ছেন, এই লক্ষণের নাম ‘সাইটাস ইনভারসাস ভিসেরাম’। ভ্রূণ তৈরির সময়ে কিছু সমস্যার কারণে এমন শারীরিক গঠন সৃষ্টি হয়। এতে সংশ্লিষ্ট মানুষটির জীবনধারণে কোনো সমস্যা হয় না। শুধু বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের অবস্থানটা উল্টে যায়। ঠিক মেপেজুপে ‘কোটিকে গুটিক’ না হলেও ডাক্তারেরা জানাচ্ছেন, ‘সাইটাস ইনভারটাসে’র সম্ভাবনা প্রতি দশ হাজারে এক। রাঁচির যে চিকিৎসক বিনোদের অস্ত্রোপচার করেছেন সেই মেজর রমেশ দাস বলছেন, ‘‘আমার দশ বছরের ডাক্তারি জীবনে এই নিয়ে এটা দ্বিতীয় ঘটনা।’’
পর্দায় দেবাশিসকে মারতে পারেননি। কিন্তু বিনোদের ঘটনা শুনে রীতিমতো অবাক ‘শজারুর কাঁটা’র ভিলেন কৌশিক সেন। ‘প্রবাল গুপ্ত’ বললেন, ‘‘পরিচালককে ঘটনাটা জানাব। উৎসাহ পাবেন। প্রকৃতিতে কত কিছুই ঘটে। আমি তো শরদিন্দুবাবুর উপন্যাসেই এই বিষয়টা পড়েছিলাম।’’
বাস্তবের বিনোদকে মারতে চেয়েছিল কে? সে রহস্য সমাধানের ভার না হয় দারোগাবাবুদের জন্যই তোলা থাক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy