ভোট দিতে গুজরাতে নরেন্দ্র মোদী। রবিবার মায়ের কাছে। পিটিআই
হিংসার তিক্ত ইতিহাস বুকে নিয়ে শান্ত হয়ে শুয়ে রয়েছে রামসাগর লেক। গোধরার ছোট্ট সদর শহরের প্রাণকেন্দ্রে। সোমবার গুজরাতের দ্বিতীয় ও শেষ দফার ভোটের আগে তা যেন আরও কিছুটা শান্ত। রাজ্যে পৌঁছে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তাঁর ভোটটি দিতে। সোমবার সকালে আমদাবাদের রানীপ অঞ্চলের একটি হাই স্কুলে ভোট দিতে যাওয়ার আগে আজ গান্ধীনগরে গিয়ে মা হীরাবেনের আশীর্বাদ নিয়েছেন তিনি। মা-ছেলের সাক্ষাৎকারটি যথারীতি ফ্রেমবন্দি হয়ে সম্প্রচারিত হয়েছে গোটা দেশে।
ভোটের আগের দিন, আমদাবাদ থেকে এসে ভদ্রক নদী পার করে গোধরা রোড বরাবর খানাখন্দময় রাস্তা গলি পার হয়ে গোধরা শহর। যেখানে যে দিকে তাকানো যায়, কাঠের ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান। গোধরায় রেল কোচে অগ্নিকাণ্ডের বিশ বছর অতিক্রান্ত। অনেক জলই গড়িয়ে গিয়েছে ভদ্রক নদী দিয়ে। কিন্তু ভোট-বাজারে ধর্মীয় মেরুকরণ বেড়েছে বই কমেনি। যাঁদের এখনও ভোটের বয়স হয়নি, সদ্য সতেরো ছাড়িয়েছেন, তাঁদেরও মতামত এ বিষয়ে খুব পোক্ত।
যেমন ধরা যাক রাণী মসজিদ সংলগ্ন একটি কাবাবের দোকানে জোগাড়ের কাজ করা ইসমাইল শেখের কথা। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট ‘আমরা-ওরা।’ ইসমাইল জানাচ্ছেন, “ওরা প্রাণপণে চেষ্টা করছে আমাদের ভোট ভাঙার জন্য। কংগ্রেস, বিজেপি ওয়েইসির দল সবাই এখানে প্রার্থী দিয়েছে। অথচ কেউই তলিয়ে বুঝতে চায় না যে, এখানে প্রতিদিন কী সমস্যার মুখে পড়তে হয় আমাদের সম্প্রদায়কে।” দোকানমালিক মেহবুব ইসমাইলের বক্তব্য, “ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়রানি। বার বার আসতে হয়, হত্যে দিতে হয়। যদিও বা অ্যাকাউন্ট খোলা হল, এটিএম কার্ড দেওয়া হয় না অনেক সময়ই। জানি না এর পিছনে কী যুক্তি রয়েছে।”
দু’লক্ষের বেশি জনসংখ্যার এই গোধরা সদরের বিধানসভা কেন্দ্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষে ৭০ হাজারের কাছাকাছি। সংখ্যার হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই তা নগণ্য নয়। বরং ভোট এককাট্টা হলে, যে দিকে যাবে তার পাল্লা ভারী। আর সেই ভোটকে এককাট্টা হতে না দেওয়াটা যেমন একটা কৌশল, তেমনই আর এক কৌশল হল কুড়ি বছর আগের দুঃস্বপ্নকে বারবার ভোটের আগে ফিরিয়ে আনা।
গোধরা বিজেপি দলীয় কার্যালয়ে বসে কার্যত তা স্বীকার করে নিলেন এখানকার দলীয় সভাপতি দিলীপ দাসাদিয়া। তাঁর বক্তব্য, “গোধরায় যা ঘটেছে, তা বহু বছর মানুষ মনে রাখবেন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও তা ভুলবে না। প্রতি নির্বাচনে করসেবকদের ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া নিয়ে চর্চা এবং নিন্দা হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আরে মশাই, গোটা বিশ্ব এটা মনে রেখেছে, আর গোধরাবাসীরা নিজেরা তা রাখবে না! বাচ্চাদের গল্পের মতো করে তা বলা হবে (হিন্দুদের) ঘরে ঘরে।”
গোধরা-কাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী হওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল স্থানীয় সমাজকর্মী মৌলনা হুসেন উমারজীকে। তুমুল সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময়ে তিনি গৃহহীনদের শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন। এগারো বছর তাঁকে বন্দি রাখার পরে ২০১৩ সালে নির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে যখন ছাড়া হল, মানসিকভাবে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না মৌলনার— জানালেন তাঁর পুত্র (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। বার বার স্বজনদের কাছে জানতে চাইতেন, ওই নারকীয় ঘটনায় তাঁর কোথায় ভুল হয়েছিল?
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন মৌলনা। আজ আর বিতর্কিত মন্তব্য করে ঝামেলায় জড়াতে চান না তাঁর পুত্র। শুধু বললেন, “হিন্দুই হোক বা মুসলিম, সাম্প্রদায়িক হিংসার কারণে যাঁদের গ্রেফতার করা হয়, তাঁদের ৯৫ শতাংশ নির্দোষ। আমি ভুলতে পারি না আমার বিয়ের দিনটা। যেদিন অসুস্থ, অশক্ত আব্বুকে কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সামনে-পিছনে পুলিশি প্রহরায়।”
জলের খুব সমস্যা এই অঞ্চলে। কাঠের ব্যবসা ছাড়া বড় কোনও উদ্যোগ নেই। নব্বইয়ের দশকে এখানে দু’টি সরকারি স্কুল ছিল। তখন এখানে যা জনসংখ্যা ছিল, এখন তার আট গুণ বেড়ে গিয়েছে হিসাবমতো। কিন্তু স্কুলের সংখ্যা বাড়েনি। সরকার অনুমোদিত বেসরকারি বিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, যেখানে হিন্দু পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের ভিড়। অন্য দিকে, মুসলিম সম্প্রদায় ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালায় পাশাপাশি। হিন্দু এবং মুসলিম পড়ুয়া একসঙ্গে পড়াশোনা করার পরিবেশ গত তিন দশকে প্রায় লোপ পেয়েছে। ফলে মেরুকরণের জন্ম হচ্ছে অঙ্কুরেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy