প্রয়াগরাজে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে কথা বলতে বলতে খুন হন ‘গ্যাংস্টার’ তথা সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন সাংসদ আতিক ও আশরফ। নিজস্ব চিত্র।
গ্রামের কবরখানায় শনিবারই ছেলের দেহ কবর দেওয়া হয়েছে। শেষকৃত্যে তাঁদেরও আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। রবিবার সেই ছেলের পাশেই কবর দেওয়া হল বাবা আতিক আহমেদ এবং কাকা আশরফকে। কড়া পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেই সম্পন্ন হল শেষকৃত্য।
রবিবার ময়নাতদন্তের পর শেষকৃত্যের জন্য আতিক এবং আশরফের দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অ্যাম্বুল্যান্সে করে প্রয়াগরাজের পৈতৃক ভিটের কাছে কাসারি মাসারি কবরখানায় নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের দেহ। আতিকের বাবা, মাকেও ওই কবরস্থানেই কবর দেওয়া হয়েছিল। সেখানে কয়েক জন প্রতিবেশী এবং দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের উপস্থিতিতে আতিক এবং আশরফের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
শনিবার রাতে উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে কথা বলতে বলতে খুন হয়েছিলেন ‘গ্যাংস্টার’ তথা সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন সাংসদ আতিক এবং আশরফ। খুন হতে পারেন, এই ভয়ে গুজরাতের সাবরমতী জেল থেকে উত্তরপ্রদেশে আসতে চাননি আতিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছে সেই আশঙ্কা। গত ১৩ এপ্রিল ঝাঁসিতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এসটিএফের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন আতিকের ছেলে আসাদ এবং তাঁর সহযোগী গুলাম। শনিবার আসাদের শেষকৃত্য হয়েছিল। এর পর রাতে নিহত হন বাবা আর কাকা। ছেলের শেষকাজে উপস্থিত থাকতে চেয়ে প্রয়াগরাজের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আর্জি জানিয়েছিলেন আতিক। কিন্তু শুনানি হওয়ার আগেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে যায়। এর পর রাতে প্রয়াগরাজের এমএলএন মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে আতিক, আশরফকে যখন মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য আনা হয়, তখন কয়েক জন সাংবাদিক তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চান। সেই সময়েই প্রায় কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে দেন আততায়ীরা।
বিএসপি বিধায়ক রাজু পালের খুন এবং সেই খুনের অন্যতম সাক্ষী উমেশ পালের হত্যাকাণ্ডেও অভিযুক্ত ছিলেন আতিক এবং আশরফ। আসাদ এবং গুলামের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। কিন্তু হাতকড়া পরা অবস্থায় পুলিশের সামনে দুই বন্দিকে প্রকাশ্যে খুনের ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের শাসকদল বিজেপির সমালোচনায় ফেটে পড়েছে বিরোধীরা। ঘটনার রাতেই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। গড়া হয়েছে তিন সদস্যের একটি কমিশনও। ২ মাসের মধ্যে কমিশনকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রাজ্যের সব ক’টি অর্থাৎ ৭৫টি জেলাতেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। প্রয়াগরাজে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা।
আতিক এবং আশরফকে গুলি করে খুনের পর ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান তুলে ‘উল্লাসের’ সময়ে ঘটনাস্থল থেকে তিন জনকে বন্দুক-সহ গ্রেফতার করে পুলিশ। ধৃতদের নাম লবলেশ তিওয়ারি, সানি এবং অরুণ মৌর্য। রবিবার তাঁদের আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, আততায়ীরা সাংবাদিক ছদ্মবেশে এসেছিলেন। রাতেই প্রয়াগরাজের পুলিশ কমিশনার রমিত শর্মা বলেন, ‘‘সাংবাদিকের ছদ্মবেশে থাকা ৩ ব্যক্তি আতিক এবং আশরফকে গুলি করেছে। এই ঘটনায় লখনউয়ের এক সাংবাদিক পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন মান সিংহ নামে এক কনস্টেবল।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, ধৃতদের জেরা করে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তথ্য জানা গিয়েছে। সকাল থেকেই আতিকদের গতিবিধির উপর নজর রাখছিলেন ওই ৩ জন। পুলিশি জেরার মুখে ৩ ঘাতক জানিয়েছেন, আতিককে মেরে অপরাধের দুনিয়ায় বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তাই, খুনের পরিকল্পনা অনেক আগেই তাঁরা করেছিলেন। সেই মতো নকল প্রেস কার্ড তৈরি করা হয়। হাতে বুম এবং ক্যামেরা নিয়ে অন্য সাংবাদিকদের ভিড়ে তাঁরা মিশে যান। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, অভিযুক্ত ৩ জনের বিরুদ্ধেই একাধিক অপরাধের মামলা রয়েছে। কোন কোন অপরাধ করেছেন, কোন কোন থানা এলাকায় সেই অপরাধের রেকর্ড রয়েছে, তার খোঁজ চালাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। পুলিশকে দেওয়া বয়ানে এক ধৃত এ-ও বলেছেন, ‘‘কত দিন আর ছোটখোটো শুটারের কাজ করব! বড় গ্যাংস্টার হওয়ার জন্যই এই খুন করেছি আমরা।’’
প্রায় একশোর উপর মামলা ছিল আতিকের নামে। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাঁকে প্রয়াগরাজের সেন্ট্রাল জেল থেকে গুজরাতের সাবরমতী জেলে সরানো হয়েছিল। সম্প্রতি উমেশ পাল হত্যা মামলার সূত্রে তাঁকে ফের উত্তরপ্রদেশে ফিরিয়ে আনতে যায় রাজ্য পুলিশ। তখনই আতিক দাবি করেন, তাঁকে খুন করতে চায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। সুপ্রিম কোর্টে সে কথা জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আইনি পথেই আতিককে হেফাজতে পেয়ে প্রয়াগরাজে ফিরিয়ে আনা হয়। সাবরমতী জেল থেকে বেরোনোর সময়েও আতিক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘‘ওরা আমাকে খুন করতে চায়।’’ উত্তরপ্রদেশে বিজেপি তথা যোগীর জমানায় আইন-কানুনের পরোয়া না করে ‘এনকাউন্টার রাজ’ চালানোর অভিযোগে আগেই সরব হয়েছিল বিরোধীরা। পুলিশের সংঘর্ষে সম্প্রতি আতিকের ছেলে আসাদের মৃত্যুর পর তা নিয়েই নতুন করে বিতর্ক দানা বাঁধছিল। তার মধ্যে আতিককে গুলি করে এই ভাবে হত্যার ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে যোগীর পুলিশের ভূমিকা।
সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব টুইটারে লেখেন, ‘‘পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে যদি কেউ খুন হন, তবে আমজনতার নিরাপত্তা কোথায়? কিছু লোক ইচ্ছে করেই আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে।’’ সমাজবাদী পার্টি সমর্থিত সাংসদ তথা আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে আতিকের পাশাপাশি আইনের শাসনকেও খুন করা হয়েছে।’’ যোগী রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ তুলে আক্রমণ করতে শুরু করেছে তৃণমূলও। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটে লেখেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে নৈরাজ্য এবং আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার ছবি দেখে আমি স্তম্ভিত। এটা চূড়ান্ত লজ্জার যে, অপরাধীরা পুলিশ এবং সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। সাংবিধানিক গণতন্ত্রে এই ধরনের বেআইনি কাজের কোনও জায়গা নেই।’’ তৃণমূলের রাজ্য মুখপাত্র কুণাল ঘোষও টুইটে লেখেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে ৩৫৬ ধারার পরিস্থিতি কি হয়নি? বিজেপি কী বলে?’’
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনও মুখ না খুললেও উত্তরপ্রদেশের অর্থমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা সুরেশ খান্না আতিক-হত্যাকে ‘ঈশ্বরের বিচার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘এটা ঈশ্বরের বিচার ছাড়া আর কিছু নয়।’’ যোগী সরকারের আর এক মন্ত্রী স্বতন্ত্র দেব সিংহ বলেন, ‘‘পাপ, পুণ্যের হিসাব এই জন্মেই হয়!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy