বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শঙ্খ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘জিএসটি চালু হওয়ার পরে ওষুধের দাম বেড়েছে। তার পরে প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিও বাড়াচ্ছে। এর পরে সরকারের তরফে দাম বাড়লে সমস্যা তো তৈরি হবেই।’’
প্রতীকী ছবি।
গত মঙ্গলবার থেকে আগামিকাল, রবিবার পর্যন্ত ছ’দিনের মধ্যে পাঁচ দিনই সারা দেশে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়ল। কাল কলকাতায় ইন্ডিয়ান অয়েলের পাম্পে লিটার-প্রতি পেট্রলের দর ৫২ পয়সা বেড়ে ১০৮.৫৩ টাকা হচ্ছে। ৫৬ পয়সা বেড়ে ডিজ়েল বিক্রি হবে ৯৩.৫৭ টাকায়। এর পরে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে আগামী পয়লা এপ্রিল থেকে প্রায় সাড়ে আটশোটি অত্যাবশ্যক ওষুধের দামও বাড়তে পারে বলে খবর।
এই ওষুধগুলির মধ্যে রয়েছে সাধারণ জ্বর-ব্যথার দাওয়াই প্যারাসিটামল থেকে শুরু করে পেট খারাপের ওষুধ এমনকি গ্যাসের ওষুধেরও একটা বড় অংশ। অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি-ইনফেকটিভ, রক্তাল্পতা, হৃদ্রোগ এবং ত্বকের কিছু ওষুধও এই অত্যাবশ্যক তালিকায় পড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সার ও রসায়ন মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি (এনপিপিএ)-র তরফে প্রকাশিত গত কালের বিজ্ঞপ্তির জেরে এই সমস্ত ওষুধের দাম প্রায় ১০.৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর ছাড়পত্র পেতে চলেছে নির্মাতা সংস্থাগুলি।
সংশ্লিষ্ট মহল জানাচ্ছে, যে সব ওষুধ আমরা ব্যবহার করি, তার ৮৫ শতাংশের দাম প্রতি বছরে মোটামুটি ১০ শতাংশ করে বাড়ানোর ছাড়পত্র নির্মাতা সংস্থাগুলিকে দেওয়াই থাকে। বাকি ১৫ শতাংশ পড়ে নথিভুক্ত অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকায়। প্রতি বছর পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অত্যাবশ্যক ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয় এনপিপিএ। গত কাল সেই সংক্রান্ত নির্দেশিকাটিই প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘‘শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হারের সূচকে ২০২০ সালের অনুরূপ সময়ের তুলনায় ১০.৭৬ শতাংশ পরিবর্তন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ওষুধের দাম নির্ধারণ সংক্রান্ত ২০১৩ সালের নির্দেশিকা অনুযায়ী পদক্ষেপ করতে বলা হচ্ছে।’’
তাৎপর্যপূর্ণ হল, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির সূচকের পরিবর্তন অনুযায়ী ২০১৯ সালে নির্মাতা সংস্থাগুলিকে অত্যাবশ্যক ওষুধের দাম প্রায় ২ শতাংশ বাড়ানোর ছাড়পত্র দিয়েছিল কেন্দ্র। ২০২০ সালে তা বাড়ানো হয়েছিল ০.৫ শতাংশ। সেই তুলনায় এ বার এক লাফে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর ছাড়পত্র দেওয়া হল। একটি ওষুধ নির্মাতা সংস্থার এক কর্তা জানান, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বিষয়টি সম্পৃক্ত, কারণ ওষুধ তৈরির কাঁচামালও এর মধ্যে পড়ছে। বর্তমানে কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, পরিবহণ— সবেরই খরচ বেড়েছে। ওষুধের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ভারত উল্লেখযোগ্য ভাবে নির্ভরশীল চিনের উপরে। কিন্তু প্রথমে কোভিড ও পরে সীমান্তে দুই দেশের টানাপড়েনের ধাক্কা লেগেছে বাণিজ্যেও। ওই কর্তা জানান, অত্যাবশ্যক ওষুধগুলির দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রের কাছে দরবার করা হয়েছিল। দাম দশ শতাংশ বাড়লেও কিছুটা সুরাহা হবে ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলির।
কিন্তু আম আদমির সুরাহার কী হবে? কোভিডের পর থেকে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন কিংবা তাঁদের আয় কমেছে। ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে বহু ছোট ব্যবসার। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যে ভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে সাধারণ মানুষ শ্বাস ফেলবেন কী করে? গত পাঁচ দিনে পেট্রল-ডিজ়েলের দর যথাক্রমে ৩.৮৬ টাকা এবং ৩.৭৮ টাকা বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, এই কয়েক দিনে দুই জ্বালানিরই দাম যে গতিতে বেড়েছে, তা অতীতের তুলনায় অনেকটাই বেশি। এই দফার আগে টানা ১৩৭ দিন দেশে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম স্থির ছিল। কলকাতায় পেট্রল ছিল ১০৪.৬৭ টাকা এবং ডিজ়েল ৮৯.৭৯ টাকা। যুদ্ধের জেরে বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের রেকর্ড ভাঙা দাম সত্ত্বেও। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন যেতে না যেতেই তা ফের মাথা তুলতে শুরু করেছে। এ ছাড়া, হালে রান্নার গ্যাসের দাম ৫০ টাকা বেড়েছে। কলকাতায় এলপিজি সিলিন্ডারের দাম দাঁড়িয়েছে ৯৭৬ টাকা। দাম বেড়েছে ভোজ্য তেল আর খাদ্যপণ্যেরও। সব মিলিয়ে হেঁশেলে আগুন ধরার জোগাড়।
সেই সঙ্গে লাগাতার দাম বেড়ে চলেছে ওষুধেরও। শুধু করোনা-কালের পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, জ্বর, সর্দি-কাশি, পেট খারাপ, বদহজম থেকে শুরু করে সুগার, প্রেশার, থাইরয়েডের মতো ক্রনিক রোগের ওষুধের একটা বড় অংশের বিপুল দাম বেড়েছে। কী করবে আমজনতা? কার্যত এর উত্তরই নেই সরকারের কাছে। কার্ডিয়োথোরাসিক শল্য চিকিৎসক কুণাল সরকার বলছেন, ‘‘রাজ্য বা কেন্দ্রের স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলিতে হাসপাতালে ভর্তি থাকলে পরিষেবা পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ের চিকিৎসার ওষুধের খরচ মেলে না। সেটা নিজের পকেট থেকেই করতে হয়।’’ তিনি জানান, বছরে মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন। গড়ে প্রত্যেক ভারতবাসীর বছরে অন্তত তিন হাজার টাকা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে খরচ হয়। তার মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ খরচই ওষুধের জন্য।
ফুসফুসের রোগের চিকিৎসক দেবরাজ যশ বলেন, ‘‘দৈনিক যদি ১০০ জন রোগী ওষুধ নেন, তাঁদের মধ্যে ২০ শতাংশ শুধু অ্যান্টিবায়োটিক পান। সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বাড়লে রোগীর উপরে বিরাট চাপ পড়বে।’’ মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাসের আশঙ্কা, ওষুধের দাম এই হারে বাড়লে অনেক রোগীই আর ওষুধের পুরো কোর্স শেষ করবেন না। আবার অনেকে ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিলেও আর চিকিৎসকের কাছে যাবেন না। শিশু রোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘সাধারণ ওষুধের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের উপরে নিশ্চিত ভাবেই চাপ পড়বে। কারণ এখন তো সব মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব ভাল নেই।’’ বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শঙ্খ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘জিএসটি চালু হওয়ার পরে ওষুধের দাম বেড়েছে। তার পরে প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিও বাড়াচ্ছে। এর পরে সরকারের তরফে দাম বাড়লে সমস্যা তো তৈরি হবেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy