Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

পাহাড় ভাঙার শব্দ, জেগেই কাটালাম দু’রাত

এখনও কানে ভাসছে গুম গুম শব্দটা। মঙ্গলবার দুপুরে কাজিগুন্দের কাছে এসে বাসটা যখন থেমে গেল, তখনও বুঝিনি পরিস্থিতি এত খারাপ। হাল্কা বৃষ্টি সঙ্গী ছিল গোটা পথ ধরেই। বাস থামতেই দূর থেকে ভেসে এল আওয়াজটা। ভেবেছিলাম পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তা তৈরি করছে সেনা। কিন্তু ভুল ভাঙল অচিরেই। চালক এসে জানালেন, সামনে পাহাড়ে ধস নামছে। এগোনোর আর উপায় নেই। দু’দিনের আগে রাস্তা ঠিক হবে কি না, কেউ জানে না। তত দিন এখানে এ ভাবেই থাকতে হবে। এই খবরটুকু দিয়েই উধাও হয়ে গেলেন কাশ্মীরি চালক।

কাশ্মীর থেকে মুম্বই হয়ে শহরে ফিরলেন বাঙালি পর্যটকেরা। ছবি: শৌভিক দে।

কাশ্মীর থেকে মুম্বই হয়ে শহরে ফিরলেন বাঙালি পর্যটকেরা। ছবি: শৌভিক দে।

দেবজ্যোতি পালচৌধুরী (কাশ্মীরের কাজিগুন্দে আটকে পড়া পর্যটক)
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

এখনও কানে ভাসছে গুম গুম শব্দটা।

মঙ্গলবার দুপুরে কাজিগুন্দের কাছে এসে বাসটা যখন থেমে গেল, তখনও বুঝিনি পরিস্থিতি এত খারাপ। হাল্কা বৃষ্টি সঙ্গী ছিল গোটা পথ ধরেই। বাস থামতেই দূর থেকে ভেসে এল আওয়াজটা। ভেবেছিলাম পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তা তৈরি করছে সেনা। কিন্তু ভুল ভাঙল অচিরেই। চালক এসে জানালেন, সামনে পাহাড়ে ধস নামছে। এগোনোর আর উপায় নেই। দু’দিনের আগে রাস্তা ঠিক হবে কি না, কেউ জানে না। তত দিন এখানে এ ভাবেই থাকতে হবে। এই খবরটুকু দিয়েই উধাও হয়ে গেলেন কাশ্মীরি চালক।

পাহাড়ের সন্ধ্যা ঝুপ ঝুপ করে নামছে। সামনেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিরপঞ্জাল। পার হতে পারলেই বানিহাল। কিন্তু যত দূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। আমাদের ষাট জনের দলটির তখন হতবুদ্ধি দশা। তত ক্ষণে খিদের চোটে কাঁদতে শুরু করেছে তিন বছরের মেয়ে মিথিকা। স্ত্রী পায়েলের চোখেও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। বারে বারেই গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বার করে দেখছে। অচেনা-অজানা জায়গা। আগে-পিছে কেবলই গাড়ির লাইন। মোবাইলের নেটওয়ার্ক আসছে-যাচ্ছে। অন্ধকারে কোথায় যাব, কী খাব, ঠান্ডার মধ্যে কোথায় মাথা গুঁজব, মনের মধ্যে ভিড় করতে থাকে প্রশ্নগুলো।

এ দিকে বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। ঠান্ডা বাড়ছে তাল মিলিয়ে। খাবারের চেয়েও তখন মরিয়া হয়ে খুঁজছি একটু আশ্রয়। কাজিগুন্দের ছোট্ট জনপদটিতে শ’তিনেক বাঙালি পর্যটকের ভিড়। রীতিমতো লড়াই করে বাড়তি টাকার লোভ দেখিয়ে একটি দোকানের দোতলায় দু’টি ঘর পেলাম। সেটাই আমাদের বাড়ির ১৭ জনের মাথা গোঁজার ঠাই। রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে যাবে শুনে ফের লেপ-কম্বল জোগাড় করতে ছুটলাম। অনেক লড়াই করে হাতে পেলাম পাঁচটা কম্বল। চার জন পিছু একটা করে। তা ছাড়া আর উপায় কী! যত গরম জামা ছিল, গায়ে চাপিয়েও ফেললাম সব।

তার পরও সারা রাত ঠান্ডায় কেঁপেছি। যত ক্ষণ জেগে ছিলাম কানে এসেছে গুমগুম শব্দ। বুঝতে পারছি পাহাড় ফাটছে। বোল্ডার গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। ক্রমশ আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি কলকাতা থেকে।

কর্মসূত্রে ২০০৫-০৬, দু’বছর কাবুলে কাটিয়েছি। ওখানে এ রকম গুমগুম আওয়াজ শুনলেই বুঝতে পারতাম মার্কিন সেনার সঙ্গে তালিবানের যুদ্ধ চলছে। ভয় পেলেও এ বারের মতো আতঙ্কে রাত কাটাইনি। শুধুই মনে হচ্ছিল, যদি একটা ছোট্ট বোল্ডারও গড়িয়ে পড়ে, তা হলেই সব শেষ। উত্‌কন্ঠায় কার্যত বসেই কাটিয়েছে দু’রাত।

জম্মু থেকে শ্রীনগর যাওয়ার পথেই বানিহাল আর রামবাঁধে ধস চোখে পড়েছিল। আফসোস হচ্ছিল, কেন তখনই ফিরে গেলাম না। ষাট জনের দল আমাদের। তার মধ্যে আমার পরিবার আর শ্বশুরবাড়ির সদস্য নিয়ে ১৭ জন। কলকাতা ছেড়েছিলাম গত ২০ মার্চ। প্রথমে কাটরা। তার পর সেখান থেকে প্রায় দশ-বারো ঘন্টার বাস সফর শেষে শ্রীনগর পৌঁছই ২৫ মার্চ। তখনই খবর পেয়েছিলাম ভূস্বর্গের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রীনগর, পহেলগাম ঘুরে প্রথম বিপদের আভাস পেলাম কাহেলগাম এসে। তত ক্ষণে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে শ্রীনগরে। স্থানীয় লোকজনই বুদ্ধি দিলেন, দেরি না করে জম্মু ফিরে যেতে। ঠিকও হল তা-ই। বিধি বাম। আটকে যেতে হল কাজিগুন্দের লেভগোড়া গ্রামের কাছে।

সেখানেই ছোট্ট দোকান ঘরে কেটে গেল দু’দিন। যে ঘরে থাকছি, সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা। টাকার বিনিময়ে রান্না করতে দিয়েছিল দোকানি। দু’বেলা চাল-ডাল ফুটিয়ে সেখানেই কোনও মতে খাওয়া সেরেছি আমরা। গত কাল দুপুর থেকেই খাবার বাড়ন্ত হতে শুরু করে। মওকা পেয়ে জিনিসের দামও আগুন। এ দিকে টানা এক দিন ধরে বোল্ডার-পাথর পড়ার পর গত কাল দুপুরে প্রথম বার আওয়াজ থামে। কিন্তু রাস্তা কবে সাফ হবে সেই ভরসা দিতে পারেনি কেউই।

বুঝতে পারছিলাম, আরও দু’-এক দিন যদি এখানে থাকতে হয়, তা হলে খাবার জোটানোই মুশকিল হয়ে পড়বে। কাগজে পড়েছি, এ রকম পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার উদ্ধারের কাজে এগিয়ে আসে। কিন্তু আমরা যে এখানে আছি, সেই খবর প্রশাসন জানবে কী করে! কোনও ভাবে এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব হল দিল্লির রেসিডেন্ট কমিশনার দফতরের কর্মী প্রসেনজিত্‌ দাসের সঙ্গে। সেই ফোনে প্রথম ধড়ে প্রাণ ফিরল। যাক, আমাদের খবরটা অন্তত জানানো গেল। কিছু ক্ষণ পরে তিনি ফোনে জানালেন শ্রীনগরে কোনও ভাবে পৌঁছতে পারলেই বিমানে করে কলকাতা ফেরানোর ব্যবস্থা করবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

সবে শ্রীনগরে ফেরার প্রস্তুতি শুরু করেছি, খবর পেলাম জম্মু থেকে জাতীয় সড়কের একাংশ খুলে দেওয়া হয়েছে। বেলা দেড়টা নাগাদ শুরু হল আমাদের জম্মু ফেরার পালা। চারিদিকে ধ্বংসলীলা। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের বুক খুবলে বেরিয়ে এসেছে পাহাড়ি ঝোরা। এক-এক জায়গায় ভেসে গিয়েছে প্রায় গোটা রাস্তাই। পথ আটকে পড়ে রয়েছে পাথর-বোল্ডার আর মাটির ঢিপি। তারই মধ্যে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে কোনও ভাবে ফালি পথ বেরিয়েছে। প্রাণ হাতে করে চলছে আমাদের বাস। প্রায় হাঁটার গতিতে। গভীর রাতে এসে পৌঁছলাম জম্মুতে। কাল থেকে আবার নতুন লড়াই। ট্রেনের টিকিটের জন্য।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy