ফড়ে রাজই কি ভবিতব্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের কৃষির, প্রশ্নটা আরও জোরাল হল এ বার। ফাইল চিত্র।
ই-নাম। না, পুরস্কার নয়। গোটা দেশের কৃষি বাজারগুলোর মধ্যে লেনদেনের বৈদ্যুতিন বাজারের ইংরাজি নাম (ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট বা eNAM)। বাংলায় রাষ্ট্রীয় কৃষি বৈদ্যুতিন বাজার। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে যখন এটা চালু হয়েছিল, তখন অবশ্য এই ব্যবস্থাকে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষককে পুরস্কার বা উপহার হিসাবেই তুলে ধরা হয়েছিল।
তবে, তিনটি কৃষি সংস্কার আইন একযোগে পাশ হওয়ার পর, এই সংস্কারকে কৃষকের ইনাম বা পুরস্কার হিসাবে দেখতে নারাজ বিরোধীরা। শুধু তাই নয়, এই সংস্কারকে সমালোচকরা ভারতের সংবিধান বিরোধী হিসাবেই দেখছেন। তাঁদের যুক্তি, এই সংস্কারের ফলে রাজ্যের হাত থেকে কৃষি সংক্রান্ত সব ক্ষমতাই চলে গেল কেন্দ্রের হাতে। রাজ্যগুলির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পথে এটাকে মাইলফলক হিসাবেও দেখছেন তাঁরা।
উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে সরকার ও এই সংস্কারের সমর্থকরাও কিন্তু এই তিনটি আইনকে মাইলফলক হিসাবেই দেখছেন। ফারাকটা হল বক্তব্যে। তাঁদের দাবি, ১৯৯০-৯১ সালের সংস্কারের অভিমুখ ছিল শিল্পকে নিজের পথে হাঁটার রাস্তা তৈরি করে দেওয়া। লাইসেন্স রাজ থেকে মুক্তি দিয়ে। যেমনটা বলছেন নীতি আয়োগের শীর্ষকর্তা অমিতাভ কান্ত। তাঁর যুক্তি, ১৯৯১-এর সংস্কার ভারতের শিল্পের রথের চাকা গড়িয়ে দিলেও, কৃষি বঞ্চিতই থেকে গিয়েছে। উল্টে কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় মান্ডির ভূমিকা কৃষকের গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংস্কার নাকি তাঁদের সেই ফাঁস থেকে মুক্তি দেবে। ঠিক যে ভাবে ১৯৯১-এর সংস্কার মুক্তি দিয়েছিল দেশের শিল্পকে।
এই বিতর্কটা বুঝে নিতে সংক্ষেপে চোখ রাখা যাক তিনটি বিলের উপর:--
ক) ফারমার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) বিল ২০২০
রাষ্ট্রপতি এই আইনে যত দিন না সই করছেন, তত দিন কৃষি রাজ্যের অধিকারেই। ২০০৩ সালে কেন্দ্রের করা মডেল এপিএমসি (এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি) আইনে রাজ্যগুলিকে কৃষি বিপণনের জন্য বাজার ভিত্তিক পরিকাঠামো তৈরি করার কথা বলা হয়। এই আইনে মূল যে বিষয়গুলো আসে সেগুলো হল—
১) কৃষকের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে চুক্তি ভিত্তিক চাষ
২) পচনশীল পণ্যের জন্যে নির্দিষ্ট বাজার ব্যবস্থা
৩) কৃষকদের নিজেদের উদ্যোগে বাজার তৈরির উৎসাহ দেওয়া, এমনকি ব্যক্তি মালিকানাতেও যাতে এই বাজার তৈরি হতে পারে তার ব্যবস্থা করা
৪) কৃষির উপর সরকারি নিয়মের রাশ শিথিল করা
এবং
৫) কৃষি বাজার থেকে আসা নানান কর ও সেস থেকে কোষাগারে আসা রাজস্ব দিয়ে কৃষি বিপণন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়।
কিন্তু যা আইন এ যাবৎ কাল হয়েছে, তার কোনওটাতেই কৃষিতে রাজ্যের অধিকারের উপর কোপ পড়েনি। প্রতিটি রাজ্যই তার সীমার মধ্যে কৃষকের স্বার্থ রাখতে যা ভাল বুঝেছে তা করেছে। বাজার থেকে সেস বা কর বসিয়ে আয়ও করেছে নিজেদের মতো করে। এমনকি পণ্য চলাচলের উপর লাগামও নিজেদের হাতে রাখতে পেরেছে।
আরও পড়ুন: তিন দাবিতে রাজ্যসভা বয়কট বিরোধীদের, ধর্না তুললেন সাংসদরা
দেশে এই মুহূর্তে প্রায় ৬ হাজার ৯০০টি মান্ডি রয়েছে। ২০১৬ সালের পরে এই মান্ডিগুলি নিজেদের মধ্যে ই-নাম ব্যবহার করে পণ্য লেনদেনও করে। উত্তরপ্রদেশে ২০১৮-১৯ সালের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ৭৫টি জেলার ২৫১টি মান্ডিতে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। সেস ও কর মিলিয়ে ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার উপর আয় করেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার।
বিরোধীদের দাবি— সংবিধানে এটি যৌথ তালিকায় থাকলেও, কৃষির উপর রাজ্যের অধিকার যে ভাবে এই আইনটি কেড়ে নিচ্ছে তা ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের মূল সুরের বিরোধী। আর কেন্দ্রের দাবি— যৌথ তালিকায় থাকার কারণেই কেন্দ্রের পূর্ণ অধিকার আছে এ বিষয়ে শেষ কথা বলার।
আরও পড়ুন: ‘কৃষক বিরোধী’ মমতা: চিঠি লিখে, টুইট করে তোপ ধনখড়ের
কেন্দ্রের দাবি, কৃষি বিপণন ব্যবস্থাকে মান্ডির ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে মুক্তি দিতেই এই আইন। মান্ডি থাকছে। কিন্তু কৃষকের দায় থাকবে না তাঁর পণ্যকে মান্ডিতেই বিক্রি করার। কৃষি পণ্য চলাচলের উপর রাজ্যের আর কোনও অধিকার থাকবে না। মান্ডির বাইরে কৃষিপণ্য লেনদেনের উপর কোনও সেস বা কর বসানোর অধিকারও আর থাকবে না রাজ্যগুলির।
বিরোধীদের দাবি, কেন্দ্র এক এক করে রাজ্যের হাত থেকে আয়ের সব রাস্তা কেড়ে নিচ্ছে। এ বার কৃষির পালা। এপিএমসি-র মূল কারণটাই ছিল যাতে কৃষকরা অন্তত ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত না হয় তা দেখা। মান্ডি ব্যবস্থা ছিল কৃষকের হাতে সেই দাম তুলে দেওয়ার প্রকৃষ্ট ব্যবস্থা। কিন্তু নতুন আইনে এই দাম পাওয়ার অধিকার কী ভাব রক্ষা করা হবে তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই প্রসঙ্গেই আসছে দ্বিতীয় আইনটি।
খ) ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসিওরান্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল, ২০২০
এই আইনেই চুক্তি চাষের কথা বলা হয়েছে। আইনে কী ভাবে কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে চুক্তি হবে তার একটা রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী কৃষকরা চুক্তি মেনে চাষ শুরু করার আগেই ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে দাম নির্ধারণ করবে। কী ভাবে সরবরাহ করা হবে, গুণমান ইত্যাদির কথা থাকবে সেই চুক্তিতে। ওই চুক্তির ভিত্তিতেই দু’পক্ষ লেনদেন করতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু এই আইনে কোথাও বলা নেই দাম নির্ধারণের ভিত্তি কী হবে। বিরোধীদের প্রশ্ন, যে দেশে গড় কৃষিজমির আয়তন ১.০৮ হেক্টর, সে দেশে এক জন কৃষক চুক্তি ভঙ্গ হলে আইন আদালতের খরচ কী ভাবে মেটাবেন? সাক্ষরতার হার যে দেশে তলানিতে, সে দেশে তো আসলে স্বাধীনতা-পূর্ব অবস্থাতেই ফিরতে চলেছি আমরা। তখন জমিদারদের হাতে ঘটিবাটি বেচতে বাধ্য হতেন কৃষকরা, আর এখন বড় ব্যবসায়ীদের হাতে সাধারণ কৃষক স্বার্থ বিক্রি হয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, এই আইনের ফলে কৃষকদের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় তা সরকার দেখবে, কিন্তু বিরোধীরা তা মানতে চাইছেন না। তাঁদের দাবি, এই আইনেই স্পষ্ট করে দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া বলে দেওয়া উচিত ছিল।
প্রশ্ন উঠেছে তৃতীয় আইনটি নিয়েও।
গ) এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল বা অত্যাবশ্যক পণ্য আইন
এই আইনের বলে চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ ও আলুর মতো অত্যাবশ্যক পণ্য হারাল তাদের অত্যাবশ্যকীয়তা। এর ফলে এ সবের উৎপাদন, গুদামজাত করা বা বিক্রি করার উপর আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকল না। শুধু তাই নয়, রাজ্যের হাত থেকে আপতকালীন বণ্টন বা কোনও রাশ টানার অধিকারও আর থাকল না। এখন থেকে কেন্দ্রের হাতে চলে গেল এ সম্পর্কিত যাবতীয় সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকায় পৌঁছলে আপনাকে কেন্দ্রের দরজায় কড়া নাড়তে হবে।
কিন্তু কখন তা পারবেন তাও বলে দেওয়া আছে। কতটা কেন্দ্রের গুদামে ধরে রাখা হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে দামের ওঠা পড়া দেখে। পচনশীল পণ্যের দাম যদি ৫০ শতাংশ আর অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বাড়ে তা হলে সরকার মাঠে নামবে, অন্যথায় নয়।
বিরোধীদের প্রশ্ন, দেশের সব রাজ্যে কৃষিপণ্যের দাম এক ভাবে বাড়ে না। তা হলে কী ভাবে এই দামের ওঠা-পড়া দেখা হবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তাঁদের অভিযোগ, সংস্কারের নামে কৃষকের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে। তাঁদের প্রশ্ন, কেন্দ্র এই অভিযোগ শুনতেও রাজি নয় কেন? কেন্দ্রায়ণের এই পথে বিরোধীরা কিন্তু দেশের মূল সাংবিধানিক ভিত্তিই নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন।
মোদ্দা কথাটা হল, এই সংস্কারের ফলে—
• রাজ্যের হাত থেকে কৃষি গেল কেন্দ্রের অধিকারে।
• মান্ডির বাইরে কৃষি থেকে আয়ের কোনও উপায় থাকল না রাজ্যের হাতে।
• চুক্তি ভঙ্গে সাধারণ কৃষকের পাশে সরকার কী ভাবে থাকবে তা জানা নেই।
• অত্যাবশ্যক হয়েও চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ আর আলু অত্যাবশ্যক থাকল না। রাজ্যের হাতেও বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণের কোনও অধিকার থাকল না।
• নানান আইন সত্ত্বেও ছোট কৃষকরা ফড়েদের হাতের শিকার। যেটুকু আইনি ব্যবস্থা ছিল কৃষক স্বার্থ রক্ষায় তাও তুলে নেওয়া হল নতুন ব্যবস্থায়। কৃষি পণ্য লেনদেনে কৃষক স্বার্থ দেখার খাতাকলমের ব্যবস্থাটুকুও তুলে নেওয়া হল।
• তৈরি হল তিন ধরনের বাজার। মান্ডি, চুক্তি চাষ, ও মান্ডির বাইরের বাজার। মান্ডি তৈরি হয়েছিল ফড়েরা যাতে কৃষকদের জমি থেকে পণ্য তুলে তাদের অত্যাচার না করতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় সমালোচকরা মনে করছেন ফড়েদের রাস্তা আরও প্রশস্ত হল।
অমিতাভ কান্তের দাবি, ১৯৯১-এর সংস্কারে কৃষি উপেক্ষিত ছিল। কেন্দ্র শিল্প-সংস্কারের পথে হেঁটে কৃষি-সংস্কারে হাত দিয়েছে। কিন্তু কৃষি আর শিল্পের অর্থনীতি বা বাজারনীতি একেবারেই এক নয়। এই সংস্কার বড় কৃষকদের সহায়ক হতে পারে। কিন্তু ছোট বা প্রান্তিকদের? প্রশ্ন থাকছে, ফড়ে-রাজই আমাদের কৃষির ভবিতব্য হবে কিনা...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy