মহম্মদ নাসির খান
‘‘উপরওয়ালার অশেষ করুণা। খোয়া গিয়েছে শুধু বাঁ চোখই!’’
করুণা?
‘‘নয় তো কী? মাথা ফুঁড়ে ঢোকা গুলি বেরিয়েছিল বাঁ চোখ বিঁধে। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল পাঁচ লিটার রক্ত। তার পরেও যে ধুকপুক করছি, এটা কি কম?’’
উত্তর ঘোন্ডার মহম্মদ নাসির খানের মাথায় ব্যান্ডেজ। চোখ থেকে কান পর্যন্ত সেলাই। আর হাতে মোবাইল। তাতে গুলি লাগার ঠিক পরের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকাই কঠিন। মৃত্যু এসে শিয়রে দাঁড়ালে, বোধহয় এক চোখের আলো নিভে যাওয়াকেও কম ক্ষতি মনে হয়!
দিল্লির সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের অভিজ্ঞতা শুনতে আজ জন-আদালতের আয়োজন করেছিল অনহদ, আমন বিরাদরি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-সহ কয়েকটি সংগঠন। সেখানে জনা ত্রিশের ‘জবানবন্দি’ শোনার পরে নাসিরকে ‘ভাগ্যবান’ মনে হওয়া সত্যিই আশ্চর্যের নয়!
এলাকায় ঝামেলার খবর পেয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি অ্যাপ-ক্যাবে বাড়ি ফিরেছিলেন নাসির। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তার চালককে বাইকে বসিয়ে বাড়ির পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন। ফেরার পথেই তাঁকে ঘিরে ফেলেছিল হেলমেটধারী এক দল দুষ্কৃতী। সেই ভিড়ে গুলির উৎস তিনি ঠাওর করতে পারেননি। কিন্তু মাথা ফুঁড়ে দেওয়া গুলি যে জীবন নিতে পারেনি, তার কৃতিত্ব চোখ এবং প্লাস্টিক সার্জনকেই দিলেন তিনি।
নাসির হোলির পর দিন ছাড়া পেলেও, এখনও এমসের ট্রমা কেয়ারে শুয়ে পঙ্কজ চৌহান। হাসপাতালে তাঁর শুয়ে থাকা ছবি মোবাইলে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ার আগে পুনম শুধু বললেন, ‘‘আমার ভগ্নীপতি কী দোষ করেছিল যে, তাঁর গলা এঁফোড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেল গুলি? বাড়িতে তিনটি বাচ্চা রোজ বাবার জন্য অপেক্ষা করে। অথচ ডাক্তার বলেছেন, এমন জ্ঞানহীন, নিশ্চল পাথরের মতো বিছানাতেই কেটে যেতে পারে এক বছর!’’ পঙ্কজের আরোগ্য কামনায় রোজ প্রার্থনা করেন পুনমেরা— ‘যত ক্ষণ শ্বাস, তত ক্ষণই তো আশ।’
সুভাষ বিহারের হারুণ আলির সেই আশাটুকুও নেই। ২৫ ফেব্রুয়ারি বাড়ি বসেই খবর পান, গুলি লেগেছে ছোট ভাই মাহরুখের চোখে। মোড়ে-মোড়ে স্লোগান। রাস্তা পাথর, আগুন আর দুষ্কৃতীর দাপটে যুদ্ধক্ষেত্র। তাই বহু বার ডেকেও অ্যাম্বুল্যান্স আসেনি। ওই অবস্থায় স্কুটারে চড়ে হাসপাতালে পৌঁছনো মাহরুখও বাঁচেননি।
ভাই যে আর নেই, তা এখনও মানতে পারছেন না মহম্মদ ইমরান। কদরপুরীর এই হস্তশিল্প ব্যবসায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরেও দেখা করে এসেছিলেন ভাই ফুরকানের সঙ্গে। বিকেলে খবর পান, গুলি লেগেছে তাঁর বাঁ পায়ে। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। যখন হল, তার পরে আর বেশি ক্ষণ বাঁচেননি ফুরকানও। যাঁর পাঁচ বছরের ছেলে, আড়াই বছরের মেয়ে আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীয়ের কান্না এখনও শুকোয়নি। মৃত্যুর খবর দেওয়া যায়নি হার্টের রোগী আম্মি-কেও। ইমরানের অভিযোগ, ‘‘প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, পুলিশের গুলিই পায়ে লেগেছিল ফুরকানের। এফআইআরে সে কথা লেখা যায়নি। কারণ, পুলিশের হাতে হয়রানির ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।’’
ভাগীরথী বিহারের রাজেন্দ্র সিংহের বাঁ পা বিঁধে ঢোকা গুলি এখনও রয়ে গিয়েছে ডান পায়ে। বাড়ির কাছেই সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদস্থলে সংঘর্ষের সময়ে জড়ো হওয়া দুষ্কৃতীদের পাথরে জখম হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ছুটে আসা গুলি পায়ে লাগতেই অজ্ঞান। রাজেন্দ্রের কথায়, ‘‘ফাঁড়া কেটেছে। ক্ষত শুকোনোয় বাদ দিতে হয়নি বাঁ পা। পরে অপারেশন করে গুলি বার করা যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন ডাক্তারেরা।’’ কিন্তু সংঘর্ষ যে ফের হবে না, সেই আশ্বাস দেবেন কে? উত্তর অধরা। ঠিক যেমন ইয়াসিন প্রশ্ন করছেন, পেটে গুলি লাগা ছেলের রক্তের ধারায় ভিজে যাওয়া তিনি ভুলবেন কী করে? কে বরাভয় দেবেন যে, এমন ঘটবে না আর কোনও বাবার সঙ্গে? যাদের ভয় ভাঙানোর কথা, সেই পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধেই আক্রান্তদের ক্ষোভ সব থেকে বেশি। তা তাঁর ধর্ম যা-ই হোক। হাজার বার ফোন করেও সময়ে পুলিশের দেখা পাননি কেউ। অভিযোগ জানাতে গিয়ে উল্টে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে বলে দাবি অনেক মুসলিমের। ঘর লুট হওয়া কারও নিশানায় স্থানীয় বিধায়ক। দোকান, বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার দায় কেউ সরাসরি চাপাচ্ছেন পরিস্থিতি সামলাতে না-আসা পুলিশের উপরে। কারও প্রশ্ন, কোনও বড় নেতার বাড়ি কখনও এমন হামলার শিকার হয় না কেন?
প্রশ্ন অজস্র। কিন্তু উত্তর কই?
চোখ হারিয়েও নিজেকে ভাগ্যবান তো ভাববেনই নাসির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy